E-Paper

নামের বদলে শুধু অক্ষর! সঙ্কেতের আড়াল কেন? উঠছে প্রশ্ন

শুধু নাম গোপন রাখাই নয়, পুলিশ যে ভাবে অভিযোগকারিণীর চিঠিতে নামগুলি সঙ্কেতের মোড়কে পেশ করেছে, তাতে তিন অভিযুক্তের কার কী ভূমিকা, সেটা গুলিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২৫ ০৮:১৬

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

গণধর্ষণের মূল অভিযুক্ত হিসেবে উঠে এসেছে একদা আইন কলেজের দাপুটে ছাত্রনেতা তথা আজকের প্রভাবশালী প্রাক্তনী ও শিক্ষাকর্মীর নাম। আলিপুর কোর্টের প্রকাশ্য নথিতে স্পষ্ট লেখা, ‘এম’ এবং তার দুই সঙ্গীর নামও। কিন্তু পুলিশের এফআইআরে ওই তিনটি নামই সাঙ্কেতিক অক্ষরে লেখা। এফআইআরের সঙ্গে যুক্ত নির্যাতিতা কলেজ পড়ুয়ার অভিযোগের মূল বয়ানটিতে তাঁর পরিচয় গোপন রাখার জন্য কিছু তথ্য মুছে সাঙ্কেতিক অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে পুলিশ বা আদালতের নথিতে ধর্ষণের শিকার বা অভিযোগকারিণীর নাম-পরিচয় গোপন করাই দস্তুর। কিন্তু পুলিশ অভিযুক্তদের নামও নথিতে গোপন করায় তদন্তকারীদের অভিপ্রায় নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে।

শুধু নাম গোপন রাখাই নয়, পুলিশ যে ভাবে অভিযোগকারিণীর চিঠিতে নামগুলি সঙ্কেতের মোড়কে পেশ করেছে, তাতে তিন অভিযুক্তের কার কী ভূমিকা, সেটা গুলিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। এমনকি, মেয়েটি সত্যিই অভিযুক্তদের নাম লিখেছেন কি না, তা নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে, নানা মহলে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পরিষ্কার, মেয়েটি তাঁর বয়ানে মূল অভিযুক্ত এমকে কলেজের প্রভাবশালী প্রাক্তনী, শিক্ষাকর্মী ছাড়াও তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রকৃত মুখ (আনঅফিশিয়াল) বলেই চিহ্নিত করেছেন। তাঁর উপরে অত্যাচারের বিবরণ তুলে ধরার সময়ে ‘এম’ যে তাঁকে ধর্ষণ করেছে, তা স্পষ্ট লিখেছেন তিনি। বাকি অভিযুক্তদেরও নাম ধরে ধরে কে কখন কী করছিল, সবিস্তার লেখেন অভিযোগকারিণী। কিন্তু অভিযোগ, এফআইআর-এর আনুষঙ্গিক প্রামাণ্য নথি হিসেবে পেশ করার সময়ে সবটাই আইনি কারণে সম্পাদিত ঢঙে পেশ করেছে পুলিশ। আবার একই সঙ্গে মূল অভিযুক্ত এমের ক্ষেত্রে ‘এম’-এর বদলে ‘জে’ লেখায় আসল পান্ডা এম না জে, তা নিয়েও সমাজমাধ্যম থেকে শুরু করে নানা মহলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। ‘এম’, ‘জে’ এবং ‘পি’— এই তিনটি অক্ষরের সঙ্কেতই পুলিশ নথিতে ব্যবহার করেছে।

হাই কোর্টের আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতা এমন ‘অদ্ভুত’ এফআইআরের বয়ানে অবাক। তিনি বলছেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার কারও সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ২০১৯ সালে নিপুণ সাক্সেনার মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা মেনেই কিছু সাবধানতা মেনে চলা হয়। ভুক্তভোগী নারী বা অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকা, কিশোরীর নাম, তাঁদের পরিজনের নাম, ঠিকানা— এ সব পুলিশ বা আদালতের নথিতে লেখা হয় না। এ ছাড়া ক্ষেত্র বিশেষে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করেই পুলিশ মেয়েটির বিষয়ে অন্য তথ্যও লেখে। কিন্তু সাধারণত অভিযুক্তের নাম গোপন করার কারণ নেই।” অনির্বাণের কথায়, “গুটিকয়েক ক্ষেত্রে ধর্ষণকারী বা অভিযুক্ত ভুক্তভোগীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বা প্রতিবেশী হলে মেয়েটির পরিচয় জানাজানি হওয়া ঠেকাতে সতর্ক থাকা হয়। এ ক্ষেত্রে একই কলেজের সিনিয়র বা অন্য দু’জন ছাত্রের নাম থেকে মেয়েটির পরিচয় জানাজানির সম্ভাবনা আছে বলে তো মনে হয় না।”

কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম কমিশনার রুপেশ কুমার অভিযুক্তদের আড়ালের চেষ্টার অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে তাঁর কাছে অভিযুক্তদের নাম গোপন করার কারণের সদুত্তর মেলেনি। তিনি বলছেন, “মেয়েটি অভিযোগ লেখার সময়ে তিন জনেরই পুরো নাম লিখেছিলেন। কিন্তু এফআইআর লেখার সময়ে বিষয়টি যাচাই করার পর্যায়ে ছিল। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের পরে তাদের নাম জানাতে পুলিশ দ্বিধা করেনি। তা ছাড়া কলেজের ছাত্র অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। অভিযুক্ত অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে নাম প্রকাশ করা যায় না।” কিন্তু অভিযোগকারিণীর সঙ্গে কথা বলার সময়েই তো মূল অভিযুক্ত কলেজের এক জন প্রাক্তনী ও শিক্ষাকর্মী, সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। তাঁর নাবালক হওয়ার প্রশ্ন উঠছে কী করে? অন্য দু’জন ছাত্রের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে সতর্কতার কিছু মাত্র কারণ যদি থাকেও, এমের ক্ষেত্রে তা একেবারেই খাটে না।

পুলিশ তিন অভিযুক্তের নামের সঙ্কেতগুলি এমন ভাবে বাছাই করেছে, তাতে বিষয়টি গুলিয়ে যাচ্ছে বলে মত অনেকের। মেয়েটির কলেজের প্রাক্তনী, বিজেপির আইনজীবী নেতা কৌস্তভ বাগচী বলেন, “এ তো পরিষ্কার, শাসক দলের নিজের লোক প্রভাবশালী এমকে আড়াল করতে পুলিশ সঙ্কেত ব্যবহার করেছে। এবং এমন ভাবে তা করা হয়েছে, যাতে বিষয়টি গুলিয়ে যায়।” অনেকের মতে, পুলিশ সতর্কতার জন্য অভিযুক্তদের নাম আড়াল করলেও ‘এম’, ‘জে’ ও ‘পি’র বদলে ‘এক্স’, ‘ওয়াই’ ও ‘ডব্লিউ’ ব্যবহার করলে অন্তত বিভ্রান্তির কারণ থাকত না। অভিযোগকারিণীর আইনজীবী অরিন্দম কাঞ্জিলাল অবশ্য বলেন, “তদন্তের সুবিধার কথা ভেবেই নিশ্চয় পুলিশ অভিযুক্তদের নামে সঙ্কেত ব্যবহার করেছে।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kasba Rape Case kasba police investigation

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy