Advertisement
২৮ এপ্রিল ২০২৪
Satyajit Ray

কোন আলো, কোন প্রাণের খোঁজ দেবে ‘রায় দিবস’

বাংলা-বাঙালির নিজস্ব অভিজ্ঞানের দেশপ্রেম কি ছাপ ফেলবে ভোটযন্ত্রে? হয়তো এর ভিত্তিতেও মালুম হবে, হারল কি জিতল সত্যজিতের মূল্যবোধ!

‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবির শুটিংয়ে সত্যজিৎ ও অন্যেরা। ফাইল চিত্র।

‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবির শুটিংয়ে সত্যজিৎ ও অন্যেরা। ফাইল চিত্র।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২১ ০৬:৪৮
Share: Save:

স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা...! একটি মজাদার ভিডিয়োয় মগনলাল মেঘরাজের ভাড়াটে খেলুড়ে অর্জুনের ছোড়া ছুরিতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে শব্দগুলো। আগামী ২ মে, সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে এই দৃশ্যই কি ভেসে উঠবে জনসাধারণের চোখের সামনে, এই ‘বঙ্গাল মুলুকে’? জল্পনা চলছিল, শুক্রবার বিশ্ববরেণ্য বাঙালি চিত্র পরিচালকের তিরোধান দিনে।

‘খেলা হবে’র পরিণামে কেমন হবে ‘খেল খতম’? দীর্ঘ ভোটযুদ্ধের শেষে কি দেখা যাবে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ‘ক্লাইম্যাক্স’? শুনে হাসছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহের উত্তরপুরুষ শাহেনশাহ আলি মির্জা। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ তৈরির সময়ে তাঁদের বাড়িতে সত্যজিৎকে আসতেও দেখেছেন তিনি।

ওয়াজিদ আলির অন্যতম পুত্র বাবর মির্জার নাতি, সাহাবজাদা ওয়াসিফ মির্জার সঙ্গে (শাহেনশাহের বাবা) দেখা করে তখন প্রায়ই টুকটাক পরামর্শ নিতেন দীর্ঘদেহী বাঙালি পরিচালক। লখনউ থেকে এসে কিছু দিন মেটিয়াবুরুজ-বাসের পরে ১৮৫৭-র কাছেপিঠে ফোর্ট উইলিয়ামে ব্রিটিশের হাতে বন্দি হয়েছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ। মুক্তির পরে ইংরেজরা তাঁকে যেখানে ইচ্ছে থাকার সুযোগ দিয়েছিল। সত্যজিৎ খানিক অবাক ভঙ্গিতেই প্রশ্ন করেন, “ওয়াজিদ আলি শাহ কেন লখনউয়ে ফিরলেন না? দেশে উর্দু ভাষা-সংস্কৃতি চর্চার এত জায়গা থাকতে কোন দুঃখে কলকাতাতেই পড়ে রইলেন তিনি?’’ অধুনা ৮৬ বছরের প্রবীণ, সাহাবজাদা সে দিন পাল্টা প্রশ্ন করেন সত্যজিৎকে। “আপনি বলুন, দেশে তো এত নামী চিত্র পরিচালক, অনেকে ভাল উর্দুও জানেন! কিন্তু ‘মাদার ইন্ডিয়া’-খ্যাত মেহবুব খান বা ‘মুঘল-এ-আজম’-এর স্রষ্টা কে আসিফ থেকে আর কেউ ওয়াজিদ আলি শাহকে নিয়ে ছবি তৈরির কথা কেন ভাবলেন না! তা হলে কি নবাব সাহেবের কলকাতায় থাকার সিদ্ধান্তটা খুব ভুল ছিল?”

ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় ১৮৮৭ পর্যন্ত নবাবের আমৃত্যু থাকা নিয়ে ইতিহাসবিদেরা কাটাছেঁড়া করলে করবেন! কিন্তু নবাবের প্রপৌত্রের পুত্র শাহেনশাহ মির্জার মতে, “বরাবরই বাংলার ডিএনএ-র ধাঁচটা আলাদা। এবং এটাই সত্যজিতের বাংলা!” এ দিন রমজান মাসের ১০ তারিখে শাহেনশাহ শোনাচ্ছিলেন মাসের প্রথম তিন ইফতারের কথা। প্রথম দিন বাড়িতে ‘বৈশাখী’ উপলক্ষে মিষ্টি পাঠিয়েছিল পঞ্জাবি হিন্দু একটি বন্ধু পরিবার। পরের দিন হালিম আসে একটি শিখ পরিবারের সৌজন্যে। তৃতীয় দিনে মির্জা সাহেবের বাঙালি হিন্দু সহকর্মী জোর করে ইফতার-পর্বের মিষ্টি পৌঁছে দিয়েছেন। শাহেনশাহ মির্জার কথায়, “পার্ক সার্কাস ময়দানের দুর্গাপুজোতেও ঝাঁকে ঝাঁকে স্থানীয় মুসলিমদের ভিড় দেখেছি। এই বাংলা সব ধর্ম, সব ভাষার লোকের!” তিনি প্রত্যয়ী, ‘‘বাংলার এই সবাইকে কাছে টানার মন কেউ সহজে পাল্টাতে পারবে না!”

বিজেপি-তৃণমূলের দ্বৈরথে মোদী-শাহের প্রচারে রবীন্দ্রনাথ-সুভাষের তুলনায় সত্যজিৎ খানিক উপেক্ষিত। নির্বাচন কমিশনের বিবেচনাতেও, ভোটগণনার জন্য সত্যজিৎ-জয়ন্তীকে আমল দেওয়া হয়নি। করোনার কল্যাণে রায় পরিবার দিনটিকে নিয়ে এ বার তত মাতামাতিতে রাজি নয়। কিন্তু ভোটকেন্দ্রিক রকমারি মিম বা ভাইরাল ভিডিয়োয় জনপ্রিয় ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ কি ‘হীরক রাজা’র অনুষঙ্গ। ‘চারুলতা’ মাধবী মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “আগন্তুকে মানুষের আইডেন্টিটি (আত্মপরিচিতি) নিয়ে বড় কথা বলে গেছেন সত্যজিৎ রায়। ধর্ম নয়, মানুষ পরিচয়টাই তাতে বড়।” অসহায় মানুষকে আলো, প্রাণ দেবে কোন ঈশ্বর, প্রশ্ন তুলে ‘আগন্তুক’-এই উৎপল দত্তের সংলাপে সত্যজিৎ স্পষ্ট করছেন ধর্ম নিয়ে তাঁর অবস্থান। “কাস্ট রিলিজিয়ন ঘোর গোলমেলে... যে জিনিস মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, সেটা আমি মানি না!” আগে ‘দেবী’ বা ‘সদ্গতি’-তেও ধর্মের কুপ্রথা, নিষ্ঠুরতা নিয়ে সরব সত্যজিৎ। “ধর্ম নিয়ে ওঁর সমালোচনা, অনেক দিক দিয়েই হিন্দুত্বের প্রবক্তাদের হজম হবে না”, বলছিলেন অর্থনীতির প্রবীণ অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্যও।

ভোটের হাওয়ায় আপাতত তুমুল জনপ্রিয় ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর একটি দৃশ্যের প্যারোডি। ফেলুদার পিস্তল থেকে মগনলাল মেঘরাজের আশপাশে পর পর ছিটকে পড়ছে গুলি। সঙ্গে সেই অমোঘ সংলাপ, ‘যারা গুন্ডা দিয়ে দেশের লোককে খুন করায়, যারা টাকার লোভে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে, তারা টাকা দিয়ে রেহাই পাবে না!’

বাংলা-বাঙালির নিজস্ব অভিজ্ঞানের এই দেশপ্রেম কি ছাপ ফেলবে ভোটযন্ত্রে? হয়তো এর ভিত্তিতেও মালুম হবে, হারল কি জিতল সত্যজিতের মূল্যবোধ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Satyajit Ray West Bengal Assembly Election 2021
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE