Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
‘উদাসীন’ স্কুলও

স্কুলগাড়ি কই? ছুটির পরে পথে অসহায় খুদেরা

কারও বয়স তিন, কারও পাঁচ, কারও সাত বছর। সঙ্গে বড় কেউ নেই।

বেলুড় থানায় সেই খুদে পড়ুয়ারা। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র

বেলুড় থানায় সেই খুদে পড়ুয়ারা। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র

শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৬ ০০:৫৩
Share: Save:

কারও বয়স তিন, কারও পাঁচ, কারও সাত বছর। সঙ্গে বড় কেউ নেই।

ভরদুপুরে জিটি রোডের মতো ব্যস্ত রাস্তায় স্কুলের পোশাকে একরত্তি ওই শিশুদের দেখে নিজের টোটো-য় বসতে দিয়েছিলেন চালক। জড়োসড়ো হয়ে সেখানেই এক ঘণ্টা বসে সমস্বরে কান্না জোড়ে খুদেরা। মঙ্গলবার লিলুয়ার বড়গেট এলাকার রাস্তায় টহল দিতে বেরিয়ে এই দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ান কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকর্মী। টোটোচালক নিফাসত আলি জানান, স্কুলগাড়ি আসেনি, তাই রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে ছিল বারোটি শিশু। টোটো নিয়ে তিনি পৌঁছলে বাচ্চারা বসতে চায়।

বালি ট্রাফিক অফিসারেরা টোটোতে চাপিয়েই ওই শিশুদের বেলুড় থানায় জমা দেন। জানা যায়, বারো জনই লিলুয়ার এক নামী বেসরকারি স্কুলের পড়ুয়া। থানা থেকে খবর পেয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ এসে নিয়ে যান খুদে পড়ুয়াদের। স্কুল সূত্রে খবর, বাচ্চারা কেজি, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়া। পরে খবর পেয়ে অভিভাবকেরা স্কুল থেকে তাদের নিয়ে যান।

জিটি রোডের মতো রাস্তায় বড় কাউকে ছাড়াই এ ভাবে ওই বয়সী শিশুদের ছেড়ে দেওয়া হল কী করে? নিয়ম অনুযায়ী, নির্দিষ্ট পরিচয়পত্র দেখে তবেই স্কুলগাড়ির কর্মীর হাতে শিশুদের তুলে দেওয়ার কথা। অন্যথায় স্কুলের বাইরে বেরোতে দেওয়ার কথা নয় কাউকেই। স্কুলগাড়ি না এলে কাদের হাতে ওই খুদেদের ছাড়া হয়েছিল? কেনই বা সময়মতো পৌঁছয়নি স্কুলগাড়ি?

স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং স্কুলগাড়ি মালিক এ নিয়ে দায় ঠেলাঠেলিতেই ব্যস্ত। দু’পক্ষের দাবিতে রয়েছে প্রচুর অসঙ্গতিও। তবে এমন ঘটলে স্কুল বা স্কুলগাড়ির বিরুদ্ধে কে, কী ব্যবস্থা নেবে, সদুত্তর মেলেনি। এই ঘটনা তাই খুদে পড়ুয়াদের নিরাপত্তাকে বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

স্কুলের অধ্যক্ষ নীলকণ্ঠ গুপ্তর দাবি, ‘‘খালাসি নির্দিষ্ট পরিচয়পত্র দেখানোর পরেই শিশুদের বেরোতে দেওয়া হয়। গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় ওই পড়ুয়াদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তবে ওদের সঙ্গে স্কুলগাড়ির খালাসিও ছিলেন।’’ তবে খুদে পড়ুয়াদের পুলিশ যখন থানায় নিয়ে গেল, তখন খালাসি কোথায় ছিলেন? থাকলে কেনই বা পুলিশকে স্কুলে খবর দিতে হল?

খালাসির উপস্থিতির দাবি মিলছে না পুলকার মালিক মণিমোহন মণ্ডলের কথার সঙ্গেও। তাঁর সাফাই, ‘‘দু’বার চাকা ফেটে যায়। দ্বিতীয় বার শিশুদের পানের দোকানির সামনে রেখে খালাসিও চালকের সঙ্গে গাড়ি সারাতে যান।’’ কিন্তু খালাসি কি তাদের স্কুলে পৌঁছে দিতে পারতেন না? ‘‘রাস্তায় বাচ্চাগুলিকে ফেলে যাওয়াটা খুবই ভুল ও অন্যায় হয়েছে,’’ মানছেন তিনি।

এলাকাবাসী পুলিশকে জানান, প্রতিদিনই স্কুল থেকে ২০০ মিটার দূরে এসে পুলকারে চাপে ওই খুদেরা। তাই প্রথমে সন্দেহ হয়নি কারও। পরে বাচ্চারা কান্না জুড়তে সন্দেহ হয়। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে পুলিশের একাংশ, সকলেরই প্রশ্ন— ব্যস্ত রাস্তায় কোনও বাচ্চা দুর্ঘটনায় পড়তে পারত। নিখোঁজও হতে পারত। দায় নিত কে?

বালি পুলকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মদন জানা বলেন, ‘‘বাচ্চাদের কেন রাস্তায় ফেলে যাওয়া হয়, জবাব চাওয়া হবে পুলকার মালিকের। দায়িত্বজ্ঞানহীন চালক বা খালাসিকে কাজ দেওয়া হয় কেন, তা-ও জানতে চাইব। তবে স্কুলও দায় এড়াতে পারে না।’’ হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট স্টুডেন্টস ক্যারিং পুলকার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক রাজা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুলকারটি আমাদের সংগঠনের নয়। তবে ঘটনাটি খুবই নিন্দনীয়।’’

কী ঘটেছিল এ দিন? স্থানীয় সূত্রের খবর, দুপুর আড়াইটে নাগাদ লিলুয়া বড় গেটের সামনে টোটো নিয়ে পৌঁছন ভোটবাগানের বাসিন্দা নিফাসত। তাঁর দাবি, সেই সময়েই ওই শিশুরা এসে তাঁর টোটোয় উঠে বসতে চায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে নিফাসত জানতে চান, পুলকার এসেছে কি না? শিশুরা জানায়, আসেনি। ওই বয়সী অতগুলি শিশুকে প্রায় এক ঘণ্টা পরেও কেউ নিতে না আসায় চিন্তায় পড়েন ওই টোটোচালক। নিফাসত বলেন, ‘‘বাচ্চাগুলো বসতে চেয়েছিল, আমিও না করিনি। প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেলেও ওদের নামিয়ে দিতে পারছিলাম না। কোথায় কী বিপদ হবে ভেবে লোকসান করেও বসেছিলাম।’’

তখনই বালি ট্রাফিকের অফিসার ঘটনাটি খেয়াল করেন। খবর পেয়ে পৌঁছন আর এক অফিসার। উর্দিধারীদের দেখে আরও ভয় পেয়ে যায় খুদেরা। শেষে চিপ্‌স, লজেন্স খাইয়ে তাদের শান্ত করা হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

school kids school bus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE