Advertisement
E-Paper

ফস্কা গেরোয় মেট্রোর নিরাপত্তা

লাগাতার জঙ্গি হানার পরিস্থিতিতে নিরাপত্তায় ঠিক কতটা আঁটোসাঁটো কলকাতা মেট্রো? শুক্রবার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজধানী ঢাকার রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা এবং ২০ জনের মৃত্যুর পরে যাত্রীরা ভেবেছিলেন, শনিবার থেকে কিছুটা হলেও নজরদারি বাড়বে শহরের লাইফলাইনে।

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৬ ০১:২৪
ডোর ফ্রেম পাশ কাটিয়েই অবাধে যাতায়াত যাত্রীদের।

ডোর ফ্রেম পাশ কাটিয়েই অবাধে যাতায়াত যাত্রীদের।

লাগাতার জঙ্গি হানার পরিস্থিতিতে নিরাপত্তায় ঠিক কতটা আঁটোসাঁটো কলকাতা মেট্রো?

শুক্রবার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজধানী ঢাকার রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা এবং ২০ জনের মৃত্যুর পরে যাত্রীরা ভেবেছিলেন, শনিবার থেকে কিছুটা হলেও নজরদারি বাড়বে শহরের লাইফলাইনে। কিন্তু কোথায় কী! যাত্রীরা দেখলেন, বাড়তি সুরক্ষা দূরে থাক, সেই চেনা গা-ছাড়া মনোভাবই এখনও দিব্যি বহাল মেট্রো স্টেশনগুলিতে।

দিল্লি থেকে সম্প্রতি কলকাতায় এসেছেন এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়। মেট্রো ধরতে এসপ্ল্যানেড স্টেশনে নেমেছিলেন তিনি। উত্তর গেট দিয়ে ঢোকার মুখে বালির বস্তার আড়ালে রাইফেল হাতে কয়েক জন নিরাপত্তারক্ষীকে দেখে ভেবেছিলেন, পাল্টে গিয়েছে মেট্রোর নিরাপত্তার হাল। কিন্তু পরদিন পার্ক স্ট্রিট প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সময়েই সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হল।

খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে লাগেজ স্ক্যানার। খোশমেজাজে গল্প করার ফাঁকে মর্জিমাফিক যাত্রীদের মালপত্র পরীক্ষা করছেন কয়েক জন পুলিশকর্মী। ব্যাগ নিয়ে বাকিরা চলে যাচ্ছেন অনায়াসে। স্টেশনগুলিতে ডোরফ্রেম মেটাল ডিটেক্টর রয়েছে। হুড়হুড় করে যাত্রীরা ঢুকছেন। অ্যালার্ম বেজে চলেছে। তবে কার ক্ষেত্রে কেমন শব্দ হচ্ছে, নজর রাখার কেউ নেই। দূরে একটি টেবিলে বসে পুলিশ এবং আরপিএফ কর্মীরা।

দড়ি বেঁধে একপাশে রাখা বিকল স্ক্যানার।

শুধু পার্ক স্ট্রিট কেন? দমদম, শোভাবাজার, নেতাজি থেকে শুরু করে মেট্রোর বেশির ভাগ স্টেশনেই নিরাপত্তার ছবিটা এ রকমই। কোনও যাত্রী যদি যেচে নিজের ব্যাগ পরীক্ষা করাতে চান, তবেই তা পরীক্ষা করা হয়। তবে বহু ক্ষেত্রে তা-ও অনিচ্ছা নিয়ে বলে অভিযোগ।

বর্তমানে কলকাতায় মেট্রো স্টেশনের সংখ্যা ২৪টি। তবে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সুড়ঙ্গের স্টেশনগুলি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মেট্রো কর্তৃপক্ষ তিনটি স্টেশনে বালির বাঙ্কার তৈরি করে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে রক্ষী দাঁড় করিয়ে রাখলেও দীর্ঘদিন ধরে ১৯টি স্টেশনেই মালপত্র পরীক্ষার স্ক্যানার ও মেটাল ডিটেক্টর যন্ত্র খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। স্বভাবতই যাত্রীরা প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে বেশির ভাগ স্টেশনেই ন্যূনতম সুরক্ষার স্ক্যানার যন্ত্রও খারাপ, সেখানে তিনটি স্টেশনে সশস্ত্র বালির বাঙ্কার বানিয়ে কী লাভ?

মেট্রোর কর্তারা জানান, যাত্রী নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই গত জানুয়ারি মাস থেকে কালীঘাট, এসপ্ল্যানেড এবং টালিগঞ্জ স্টেশনে বাঙ্কার তৈরি হয়েছে। যার ভিতরে থাকছে রেল-সুরক্ষার বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডো বাহিনীর চার সদস্যের দল। যে কোনও প্রয়োজনেই সেই দল কাজে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন মেট্রোকর্তারা। রেল সূত্রে খবর, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলির তরফে হুমকি থাকায় যাত্রী-নিরাপত্তা নিয়ে গত তিন বছর ধরে রেলের বিভিন্ন জোন-এ বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে একটি, ‘ইন্টিগ্রেটেড সিকিউরিটি সিস্টেম’ বা ‘আইএসএস’-এর শর্ত মেনেই মেট্রো রেলে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা খরচ করে বসানো হয়েছিল ২৩টি এক্স-রে লাগেজ স্ক্যানার যন্ত্র। মেট্রো সূত্রের খবর, যন্ত্রগুলি বসানোর বছর দুয়েকের মধ্যেই চারটি স্টেশন ছাড়া বাকি সব ক’টিতে তা অকেজো হয়ে পড়ে। তার পরে আর যন্ত্রগুলি সারানোও হয়নি।

‘সগর্ব’ ঘোষণা, স্ক্যানার বিকল।

তবে মেট্রোর জনসংযোগ আধিকারিক ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, অকেজো হয়ে পড়ার পরে নির্মাণ সংস্থা যন্ত্রগুলি সারানোর ব্যাপারে ঢিলেমি দেখানোয় তাদের সরিয়ে নতুন করে যন্ত্র সারানোর জন্য দরপত্র ডাকা হয়েছিল। তাতে কেউ সাড়া না দেওয়ায় ফের দরপত্র চাওয়া হয়েছে। আগামী শুক্রবার ওই দরপত্রগুলি খোলার দিন। তার পরেই ওই যন্ত্রগুলি মেরামতির কাজ শুরু করা হবে। কিন্তু যে যন্ত্র মেট্রোয় যাত্রী-নিরাপত্তার অন্যতম অঙ্গ, যে যন্ত্র কিনেছে মেট্রোই, সেগুলি অকেজো হলে লাল ফিতের ফাঁসের যুক্তিতে যাত্রীদের ভুগতে হবে কেন? সদুত্তর মেলেনি।

কলকাতা মেট্রোর মোট দৈর্ঘ্য ২৭.৬ কিলোমিটার। আর দিল্লি মেট্রো তার ব্যাপ্তি বাড়ানোর পরে মোট যাত্রাপথ দাঁড়িয়েছে ১৮৯ কিলোমিটার। দিল্লির তুলনায় কলকাতা মেট্রোর যাত্রী-সংখ্যা (সাড়ে ৬ লক্ষ) নগণ্য। কিন্তু তার পরেও বারবার কলকাতার যাত্রী-নিরাপত্তার হাল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আর সেখানে দিল্লি মেট্রোর নিরাপত্তা নিয়ে তেমন অভিযোগ ওঠেনি এ পর্যন্ত। দুই মেট্রোর পার্থক্য বলতে দিল্লি মেট্রোর কিছুটা অংশ বাদ দিলে প্রায় বেশির ভাগটাই মাথার উপরে। আর কলকাতা মেট্রোর বেশির ভাগটাই মাটির নীচে, সুড়ঙ্গ দিয়ে। আর সে জন্যই কলকাতা মেট্রোর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত যাত্রী থেকে পুলিশ-প্রশাসন সকলেই।

কলকাতা মেট্রোয় নিরাপত্তা বেহাল হয়ে পড়েছে, তা অবশ্য মানতে নারাজ মেট্রো কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, বর্তমানে কলকাতার ২৪টি মেট্রো স্টেশনে ঢোকার মুখেই রয়েছে ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যৌথ ভাবে ওই ব্যবস্থার দায়িত্বে আরপিএফ এবং কলকাতা পুলিশের মেট্রো রেল পুলিশ। প্রতিটি স্টেশনের ঢোকার মুখে গেটে থাকেন কলকাতা পুলিশের নিরাপত্তাকর্মীরা। পুলিশ জানিয়েছে, ২৪টি স্টেশনের ১৯টিতেই স্ক্যানার বহু দিন ধরে খারাপ থাকায় সন্দেহজনক মালপত্র হাতে-হাতেই পরীক্ষা করতে হচ্ছে। প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে রয়েছে ‘ডোর ফ্রেম মেটাল ডিটেক্টর’ গেট। সঙ্গে প্রহরায় সশস্ত্র আরপিএফ বাহিনী। সঙ্গে সিসিটিভি ক্যামেরা তো রয়েছেই। সেই ক্যামেরা যে যথেষ্ট সক্রিয়, তার প্রমাণও সোমবার মিলেছে বলে দাবি করেন মেট্রোকর্তারা। জনসংযোগ আধিকারিক জানান, এ দিন একটি স্টেশনে এক ব্যক্তি মোবাইলে ছবি তুলছিলেন। সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারিতে তা ধরা পড়েতাই তাঁকে নিরস্ত করা হয়।

এ ছাড়াও মেট্রোর দাবি, প্রতিটি স্টেশনে প্রতিনিয়ত স্নিফারডগ নিয়ে তল্লাশি চলে। ঘুরে বেড়ায় সাদা পোশাকের পুলিশও। গোয়েন্দা বাহিনীর খবর থাকলে বিশেষ দিনগুলিতে থাকেন মেট্রো রেলের গেজেটেড অফিসারদের প্রতিনিধিদলও। প্রতিদিন দু’টি প্রান্তিক স্টেশন থেকে শেষ দুটি ট্রেনে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ সশস্ত্র পুলিশ প্রহরা। যাত্রী-নিরাপত্তায় চলছে রেলের গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনীর তথ্য আদানপ্রদানও।

তবে মেট্রোকর্তাদের বক্তব্য আশ্বস্ত করতে পারেনি যাত্রীদের। তাঁদের কথায়, ‘‘কলকাতা মেট্রো অন্যান্য রাজ্যের মেট্রোর চেয়ে অনেক পুরনো। দেশের প্রথম মেট্রো। কিন্তু তার পরেও দিল্লি পারে। আমরা পারি না। উৎকণ্ঠাও তাই কমে না।’’

সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

metro station Security
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy