E-Paper

যৌন নিগ্রহের এফআইআর খচিত ‘এমএম’

অভিযোগ, এ তো শুধু এফআইআর দায়ের হওয়া ঘটনার বিবরণ। থানায় তার বিরুদ্ধে নিগ্রহ, টাকা হাতানো, হুমকি, মারধর, র‌্যাগিংয়ের মতো জমা পড়া লিখিত অভিযোগের সংখ্যা প্রচুর।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ ০৮:৩৫
ধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্তের অনুগামীদের দেওয়াল লিখন কলেজের দেওয়ালে।

ধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্তের অনুগামীদের দেওয়াল লিখন কলেজের দেওয়ালে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

২০১৩ সাল। কালীঘাট মন্দির চত্বরে রাতে এক যুবকের বুকে ছুরির কোপ বসিয়ে ফেরার। পুলিশ এফআইআর করে তদন্তে নামলেও পরের প্রায় তিন বছর সে অধরা। ২০১৭ সালে দ্বিতীয় দফায় দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজে ভর্তি হয়েই ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। গড়িয়াহাট থানা (তখন কলেজটি গড়িয়াহাট থানার অন্তর্গত) এফআইআর করে তদন্তে নামলেও তাকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে অভিযোগ। ২০২২ সাল। কলেজের এক প্রথম বর্ষের ছাত্রীকে যৌন নিগ্রহের অভিযোগে কসবা থানায় তার নামে এফআইআর। এবং পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিল সে।

অভিযোগ, এ তো শুধু এফআইআর দায়ের হওয়া ঘটনার বিবরণ। থানায় তার বিরুদ্ধে নিগ্রহ, টাকা হাতানো, হুমকি, মারধর, র‌্যাগিংয়ের মতো জমা পড়া লিখিত অভিযোগের সংখ্যা প্রচুর।

দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজের এ হেন প্রাক্তন পড়ুয়া তথা বর্তমানে ওই কলেজের অস্থায়ী কর্মীকে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, কলেজেরই এক ছাত্রীকে ধর্ষণ ও বেধড়ক মারধরের অভিযোগে। অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে ওই কলেজেরই আরও দুই ছাত্রকে। এ ব্যাপারে খোঁজ করতে দক্ষিণ কলকাতার ওই কলেজে গিয়েই শুক্রবার চোখে পড়ল, কলেজে ‘এম’কে নিয়ে বিশাল দেওয়াল লিখন। তাতে লেখা, ‘দাদা আমাদের হৃদয়ে রয়েছে’। এর তলায় লেখা ‘টিম এমএম’। তার উপরেই দেওয়ালে নীল-সাদা রঙে লেখা ‘টিএমসিপি। আমরা সবাই সার্থক...’।

কলেজের মূল ফটক পেরিয়ে ঢুকতেই সরাসরি উল্টো দিকের দেওয়ালে এই লেখা দেখিয়ে কলেজের এক বর্তমান পড়ুয়া বললেন, “টিম এমএম-এর অর্থ হল তাঁর টিম। সাত তলা এই কলেজে ঘুরলেই চোখে পড়বে জায়গায় জায়গায় ‘টিম এমএম’ লেখা এমন পোস্টার, হোর্ডিং, দেওয়াল লিখন। কারণ, এই কলেজে এমএম-ই শেষ কথা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অধ্যক্ষের চেয়েও ক্ষমতা বেশি তার। কাছের লোকেরা ওকে ম্যাঙ্গো বলে ডাকেন। কলেজে পড়ুয়াদের ভর্তি করানো থেকে ইউনিয়নের কে কোন পদে বসবেন— সবই তার ইচ্ছার উপর। এমনকি, কোন শিক্ষক, কখন, কোন ক্লাস নেবেন, তা-ও ঠিক করে দেয় ম্যাঙ্গোই।” অভিযোগ, পান থেকে চুন খসলেই অধ্যক্ষ বা সহকারী অধ্যক্ষ ঘেরাও হবেন, শিক্ষকদের গাড়ি কলেজে ঢুকতে পারবে না। কখনও কখনও শিক্ষকদের গাড়ি ভাঙচুরও করা হবে। অভিযোগ, সে নাকি কলেজ পরিচালন সমিতিরও শেষ কথা। তার সুবিধা-অসুবিধা দেখেই নাকি স্থির করা হয় পরিচালন সমিতির বৈঠক!

অভিযোগ, কলেজের এই দাদাগিরি মনোজিতের পাড়াতেও। কালীঘাট মন্দির চত্বরেই তার বাড়ি। বাবা, মা এবং বোনকে নিয়ে পরিবার। কালীঘাট মন্দির চত্বরে পারিবারিক পেঁড়ার দোকান রয়েছে। বাবা অন্য ছোটখাট ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত। ওই পাড়ার এক বাসিন্দার মন্তব্য, “কালীঘাট থানা কার্যত মনোজিতের ঘর-বাড়ি। ওর এবং ওর বাড়ির লোকের দাপটে পাড়ার লোকেরা অনেকেই সিঁটিয়ে থাকেন।”

২০১২ সালে ল কলেজে ভর্তির এক বছরের মধ্যেই ছুরি মারার অভিযোগে কালীঘাট থানায় মামলা হয় মনোজিতের বিরুদ্ধে। সেই থেকে ফেরার ‘এম’ ২০১৭ সালে নতুন করে ল কলেজে ভর্তি হয়। ২০২১ সালে চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা পাশ করলেও কলেজ ছেড়ে যায়নি সে। ২০২২ এবং ২০২৩ সালে একাধিক গোলমালে নাম জড়ায় এই কলেজের। অভিযোগ, সমস্ত ক্ষেত্রেই অভিযোগ এবং এফআইআরে পান্ডা হিসেবে নাম রয়েছে মনোজিতের। ২০২২ সালে শেষ বার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মনোনীত ইউনিয়নের ইউনিট ভেঙে দিয়ে নিজের মতো করে ইউনিট তৈরি করে।

এই সময়ে হাজরার একটি কলেজের প্রাক্তন ছাত্রনেতার মদতে ল কলেজে একচ্ছত্র ক্ষমতা দখল করে সে। সমাজমাধ্যমে তার একাধিক পোস্টে এই সময় থেকেই তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে ছবি দেওয়ার বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়ে। দলীয় নেতৃত্বের ‘কাছের ছেলে’ বলেও পরিচিত। ল কলেজে দায়িত্বে থাকা এক নেত্রীকে সরিয়ে মনোজিতকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন ছাত্র নেতৃত্ব। সংগঠনের একাংশের অভিযোগ, এই সিদ্ধান্তের পিছনে লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেনের অঙ্ক রয়েছে। পরে ল কলেজের চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেয় সে। কলেজেরই এক প্রাক্তন ছাত্রের কথায়, “পরিচালন সমিতির বৈঠকে সে দিন কোনও ভোটাভুটিই হয়নি। অন্য বেশ কিছু আবেদন জমা পড়লেও সুযোগ পেয়ে যায় সে। পরিচালন সমিতির সভাপতি, তৃণমূল নেতা অশোক দেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে তার।” অশোক দেবের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য যদিও দাবি করেছেন, “২০১৯ সালে দক্ষিণ কলকাতা জেলার সবচেয়ে নিম্ন যে পদ, যে সংগঠন থেকে ছাত্রনেতারা উঠে আসেন, তাঁকে সেই সংগঠনের সম্পাদক করা হয়েছিল। আমাদের ব্যর্থতা যে আমরা জ্যোতিষবিদ্যা জানি না। তাই ২০২৫ সালে তিনি কিছু করবেন কি না, যদি সত্যি কিছু করে থাকেন, তা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি।” প্রশ্ন ওঠে, ২০১৩ সাল থেকেই যে মনোজিতের নামে একাধিক দফায় থানায় মামলা হয়েছে, সেটিও কি জানা ছিল না? উত্তর মেলেনি।

একই ভাবে পাড়ায় ‘ভাল ছেলে’ বলে পরিচিত প্রমিতের ধর্ষণের ঘটনায় জড়িয়ে পড়া মেলাতে পারছেন না হাওড়ার চ্যাটার্জিহাটের হরিনাথ ন্যায়রত্ন লেনের বাসিন্দাদের অনেকেই। বছর কুড়ির প্রমিত এলাকায় ঋজু নামে পরিচিত। সেখানকার এক বাসিন্দা বলেন, “ভাল পরিবারের ছেলে প্রমিত। সে-ও ভাল ছেলে। ওর নামে কোনও রকম খারাপ কিছু তো শোনা যায়নি এর আগে।” তিলজলায় গুলাম জিলানি খান রোডে জাইবের বাড়িতেও সকলে বিভ্রান্ত। ছেলে কী ভাবে এমন একটি ঘটনায় জড়িয়ে পড়ল, তা বুঝে উঠতে পারছেন না কেউই। এক আত্মীয় বলেন, “মনোজিতের জন্যই আমাদের ছেলেটা ফেঁসে গেল।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kasba Rape Case

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy