Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

নগর-মনে ভয় ধরাচ্ছে রবিনসনের কঙ্কাল-কাণ্ড

প্রাণবন্ত মেয়ে দিব্যি হইহই করে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। পড়াশোনাতেও ভাল ছিল। গত কয়েক দিন ধরে মধ্য কলকাতার নামী স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির সেই ছাত্রীকে অদ্ভুত এক ভয় পেয়ে বসেছে। এক মুহূর্ত অন্ধকার সহ্য করতে পারে না। একা থাকতেই পারে না।

দে বাড়িতে কৌতূহলীদের ভিড় কমেনি। সোমবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

দে বাড়িতে কৌতূহলীদের ভিড় কমেনি। সোমবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৫ ০২:৩৩
Share: Save:

প্রাণবন্ত মেয়ে দিব্যি হইহই করে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। পড়াশোনাতেও ভাল ছিল। গত কয়েক দিন ধরে মধ্য কলকাতার নামী স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির সেই ছাত্রীকে অদ্ভুত এক ভয় পেয়ে বসেছে। এক মুহূর্ত অন্ধকার সহ্য করতে পারে না। একা থাকতেই পারে না। বাথরুমে গেলে মা বা বাড়ির কাউকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। রাতে ঘুমোতে গিয়ে বারবার চমকে উঠে বসে বলে, ‘‘চোখ বন্ধ করলেই বিছানায় শোয়ানো কঙ্কালের ছবিটা ভেসে উঠছে। ভয় করছে আমার।’’ বকে, বুঝিয়েও কিছু হয়নি। শেষে দেশপ্রিয় পার্কের বাড়ি থেকে গত শনিবার সকালে মেয়েকে ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি’ (আইওপি)-তে দেখাতে এনেছিলেন উদ্বিগ্ন বাবা-মা।

শুধু সাড়ে এগারো বছরের এই মেয়েটিই নয়, গত চার দিনে আইওপি-তে এমন পাঁচ জন রোগী এসেছেন। সর্বক্ষণ বাড়িতে-পাড়ায়-স্কুলে-অফিসে-সংবাদমাধ্যমে রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল-কাণ্ডের আলোচনা শুনে আর ছবি দেখে মানসিক ভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তাঁরা। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলা হচ্ছে ‘প্যানিকি’ হয়ে যাওয়া। মনোচিকিৎসকদের ব্যাখ্যায়, এক-এক জনের মনের গঠন এবং চাপ নেওয়ার ক্ষমতা এক-এক রকম। ফলে রবিনসন স্ট্রিটের মতো ‘রেয়ারেস্ট অব দ্য রেয়ার’ ঘটনা অপেক্ষাকৃত নরম, দুর্বল, দুশ্চিন্তাপ্রবণ মন বা অতি-কল্পনাপ্রবণ মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেই পারে। আর সেটাই ঘটছে। কিছু মানুষ ভয়ের আবেগে মানসিক ভাবে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। সর্বক্ষণ মাথায় এই ঘটনাই ঘুরছে।

মানসিক চিকিৎসার জন্য কঙ্কাল-কাণ্ডের পার্থ দে নিজেই শুধু হাসপাতালে ভর্তি হননি, তাঁর সৌজন্যে শহরের অনেককে এখন মানসিক হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। চলছে কাউন্সেলিং, খেতে হচ্ছে ওষুধ। ষষ্ঠ শ্রেণির ওই ছাত্রীর পাশাপাশি আতঙ্কিত হয়ে আইওপি-তে এসেছেন বৌবাজারের বাসিন্দা, উত্তর কলকাতার বাংলা মাধ্যম স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী, বালির বাসিন্দা তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্র, মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দা ১৯ বছরের এক ছাত্রী এবং শহরের এক মেডিক্যাল কলেজের ২৮ বছরের মহিলা চিকিৎসক। প্রত্যেকেরই কাউন্সেলিং শুরু হয়েছে। আইওপি-র মনোবিদ প্রশান্ত রায় জানিয়েছেন, দিন-রাত সর্বত্র এই কঙ্কাল-কাণ্ডের আলোচনার জেরে অনেক মানুষই ঘটনাটিতে কাল্পনিক পুনর্নির্মাণ করছেন। কেউ মনে করছে শব খাওয়া হচ্ছে, কেউ কঙ্কালের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক কল্পনা করছেন। তাতে যে রোমহর্ষক ঘিনঘিনে অনুভূতি হচ্ছে, তাতেই ‘প্যানিক ডিজঅর্ডার’ হচ্ছে।

কলকাতার এক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী, ১৯ বছরের মেয়েটি বলছিল, ‘‘এত বড় হয়ে গিয়েছি, তবু কঙ্কাল-কাণ্ড শোনার পর থেকে অন্ধকারে থাকতে পারছি না। আমার প্রচুর সফ্‌ট টয় রয়েছে। পার্থ দে-র বাড়িতে অনেক পুতুল মাথা কাটা, হাত ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলির মধ্যেও নাকি আত্মা ঢোকানো হত। এ সব শোনার পর থেকে আমার নিজের পুতুলগুলো দেখলেই ভয় করছে। মা-বাবাকে বলায় কাউন্সেলিংয়ে নিয়ে এসেছেন।’’ আতঙ্কিত মহিলা চিকিৎসকও জানাচ্ছিলেন, তিনি নিজেই নিজের কাউন্সেলিং করার চেষ্টা করেছেন। তার পরেও বারবার দে বাড়ির ঘটনা মনে পড়লেই নাড়ির গতি বেড়ে যাচ্ছে, বুক ধড়ফড় করছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তাঁকে আইওপি-তে চাপ কাটানোর কিছু ব্যায়াম দেওয়া হয়েছে। আইওপি-র প্রধান প্রদীপ সাহা বলেন, ‘‘সম্প্রতি নেপালের ভূমিকম্পের পরে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ২২ জন রোগী এসেছিলেন প্যানিক ডিজঅর্ডার নিয়ে। তাঁদের কারও মনে হচ্ছিল, মাঝেমধ্যেই চারপাশ দুলে উঠছে, মাথা ঘুরছে। আবার কারও মনে হচ্ছিল, এখনই ভূমিকম্পে তিনি মারা যাবেন। কঙ্কাল-কাণ্ডের ক্ষেত্রেও অনেকেরই তেমন হচ্ছে।’’

মনোবিদ নীলাঞ্জনা স্যানালের ব্যাখ্যা, মরার খুলি, মৃত্যু, তন্ত্রমন্ত্র, কঙ্কাল এ সব ঘিরে অনেকের এমনিই ভয় আছে। সেগুলি বাস্তবে উঠে আসতেই অনেকের মনে ধাক্কা লেগেছে। যে সব জিনিস হতে পারে বলে বিশ্বাস করা যায় না, সেটাও হচ্ছে। এই তীব্র অস্বস্তিকর ব্যাপারটাই তাঁদের মনকে বিকল করে দিচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE