শিবকাশীর মতো বাজি তৈরি করে এক সময়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন নুঙ্গির বাঙালি কারিগরেরা। কলকাতার বাজিপ্রেমীদের অনেকেই বলেন, নুঙ্গির বাজির বৈচিত্র্য ও বাহার দিনে দিনে আরও বেড়েছে। ফলে নুঙ্গির বাজি সারা রাজ্যেই প্রবল জনপ্রিয়।
চিনের বাজি এখনও এ রাজ্যের বাজারে ঢুকতে পারেনি। তবে এ বছর থেকে চিনে ছাপ মারা ফানুস বাজার দখল করে নিতে শুরু করেছে। আর শহরের ফানুসপ্রেমীরা বলছেন, বাংলার বড় ফানুসের ওই ছোট আকারের চিনে সংস্করণ এ রাজ্যেও ঘরে ঘরে তৈরি করা সম্ভব। আর বাণিজ্যিক ভাবে কেউ তৈরি করতে চাইলে লক্ষ্মীলাভও হবে।
ফানুসপ্রেমীদের বক্তব্য, এ ক্ষেত্রে পুঁজি খুব বেশি লাগে না। কাঁচামালও সহজলভ্য। বিশেষ কোনও যন্ত্রপাতির প্রয়োজন নেই। দরকার এক ফালি জায়গা আর ছোট ফানুস তৈরির সামান্য দক্ষতা। ফলে কয়েক জন মিলে উদ্যোগী হলেই ফানুসের ব্যবসায় আর চিনে ছাপের দরকার হবে না। ‘মেড ইন কলকাতা’ লিখেই বাজিমাত করা সম্ভব।
বেলগাছিয়ার ফানুসপ্রেমী দেবাশিস মুখোপাধ্যায় মনে করেন, খুব সহজেই ছোট ফানুস বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি করা যায়। তাঁর দাবি, ফানুস তৈরি করতে গেলে যে সমস্ত কাঁচামাল লাগে, বাজারে তা-ও সহজে মেলে। ফলে যে কেউ অল্প পুঁজি নিয়ে নামতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে তিনি নিজেও তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
কলকাতার যে সমস্ত বনেদি বাড়িতে কালীপুজোর সময়ে ফানুস ওড়ানোর চল রয়েছে, সাধারণত তারা বড় ফানুস তৈরি করে। একটি বড় ফানুস তৈরি করতে খুব বেশি খরচও পড়ে না। অভিজ্ঞতা ও দক্ষ হাতেই ওই সমস্ত ফানুস তৈরি করে ওড়ানো হয়। সেটা এক ধরনের শখ ও ঐতিহ্য। বংশ পরম্পরায় ফানুস ওড়ানোর এই রীতি চলে আসছে।
গত দু’বছরে দীপাবলির শহরে ফানুস যে ভাবে আমজনতার সঙ্গী হয়ে উঠেছে, তাতে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে এখানেই বড় আকারে উৎপাদন করা সম্ভব।
উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরেই ফানুস তৈরি করে উড়িয়ে আসছেন অজয় দত্ত। তাঁর কথায়, ৮-১০ ফুটের একটি বড়া ফানুস তৈরি করতে খুব বেশি হলে কাঁচামালের পিছনে খরচ হয় ৩০০ টাকার মতো। তার সঙ্গে যে যেমন মজুরি যোগ করবে। ফলে বড় ফানুস তৈরি করতেই যেখানে সামান্য এই টাকা খরচ হয়, সেখানে বাজারের সাধারণ ফানুসগুলি তৈরি করতে খুব বেশি হলে ৮-১০ টাকা খরচ পড়বে বলে তাঁর দাবি। অজয়বাবু জানান, সামান্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারলেই এক-দেড় হাজার টাকার কাঁচামাল কিনে হাজার চারেক ছোট ফানুস বানানো সম্ভব। এমন কোনও বাঙালি তরুণ উদ্যোগপতি ফানুস তৈরির ব্যবসায় নামতে চাইলে তিনিও নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। অজয়বাবু মনে করেন, ফানুস নিয়ে মানুষের আগ্রহ যে ভাবে বেড়েছে, তাতে সামনের বছর ফানুসের চাহিদা আরও বাড়বে ও জোগান দিয়ে শেষ করা যাবে না।
এ বছর খুচরো বাজারে যে চিনে ফানুস বিক্রি হয়েছে, প্রথম দিকে তার দাম ছিল ২৫-৩০ টাকা। কালীপুজোর দিন ওই ফানুসই অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। পাইকারি বাজারে ওই ফানুস বিক্রি হয়েছে ১৫-১৮ টাকায়। ফানুসগুলির মান যে খুব খারাপ, তা নয়। ঠিকমতো জ্বালাতে পারলে আকাশে এক-দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যাচ্ছে। ফলে এখানকার কোনও সংস্থা কিছুটা উন্নতমানের কাগজ ও অন্যান্য কাঁচামাল ব্যবহার করে একই দামের মধ্যে অনেক ভাল ফানুস তৈরি করতে পারবে বলেই অভিজ্ঞজনেরা বলছেন।
ফানুসপ্রেমীদের মতে, ফানুসের বাণিজ্যিকরণ দরকার। তা হলে বাংলার এই ঐতিহ্যই কোটি-কোটি টাকার ব্যবসার দরজা খুলে দিতে পারে। তাঁদের মতে, বাঙালির আলুভাজা এখন বহুজাতিক সংস্থার রঙিন মোড়কে মোড়া ‘পোট্যাটো চিপস’। হয়তো দেখা যাবে, বাংলার ফানুসও এক দিন বহুজাতিক কোনও সংস্থার ছাপ মারা দামি পণ্য হয়ে যাবে। অজয়বাবুরা চান, বাংলার ফানুস বেঁচে থাকুক। তাই তাঁরা প্রতি বছর গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে ফানুসকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হাতে-কলমে শেখাতেও রাজি।
দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা-সহ বাংলার বিভিন্ন উৎসব-পার্বণের ঐতিহ্য ও পরম্পরা নিয়ে গবেষণা করছেন হরিপদ ভৌমিক। তাঁর কথায়, কার্তিক মাসের এই সময়ে পূর্বপুরুষদের আলোর বাতি দেখানোর রেওয়াজ এই বাংলায় বহু দিনের। আজও গ্রাম-বাংলায় সন্ধ্যে হলেই লম্বা বাঁশের মাথায় আলো জ্বালানো হয়। এই বাতি জ্বালানোর কাজটাও কম কঠিন নয়। বাঙালি দীর্ঘদিন ধরেই এই আলোকবাতি তৈরি করে আসছে। এই বাংলায় ফানুসের জন্ম অনেকটা সেই ধারনা থেকেই। অষ্টাদশ শতকে কলকাতায় কয়লার গ্যাস আসার পরে গ্যাস বেলুন উড়েছিল। তাতেও প্রথম সওয়ারি ছিলেন এক বাঙালি। ফানুসকে জনপ্রিয় করতে পারলে বাঙালির যেমন লক্ষ্মীলাভ হবে, পরম্পরাও ধরে রাখা যাবে বলে হরিপদবাবু মনে করেন।
ফানুসপ্রেমীরা বলছেন, কয়েক হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে বাজারে নামলে তেমনই অসংখ্য খুদে ফানুস বানানো সম্ভব। কাগজের ঠোঙা বানানোর মতোই সরু তারের কাঠামোর উপরে পাতলা কাগজের আস্তরণ দিয়ে বেলুন তৈরি করে তাতে গ্যাস ভরার জন্য মোমবাতি-সহ অন্যান্য রসায়নিক পদার্থের মণ্ডটি তৈরি করে দিলেই ফানুস তৈরি হয়ে যায়। চিনে ফানুসকে টেক্কা দেওয়ার মতো সেই অভিজ্ঞতা এই বাংলার রয়েছে বলেই অভিজ্ঞজনেরা বলছেন।