Advertisement
E-Paper

বদলেছে অনেক, তবু টানটা এখনও অটুট

জন্ম থেকে জীবনের পঞ্চাশটা বছর যেখানে কাটিয়েছি তার প্রত্যক্ষ প্রভাব মিশে আছে আমার অস্থি-মজ্জায়, জীবনের পরতে পরতে। টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো ছাড়িয়ে চণ্ডী ঘোষ রোড আর চণ্ডীতলা অঞ্চল আমার সেই পাড়া।

সুদীপ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:০৮
ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

জন্ম থেকে জীবনের পঞ্চাশটা বছর যেখানে কাটিয়েছি তার প্রত্যক্ষ প্রভাব মিশে আছে আমার অস্থি-মজ্জায়, জীবনের পরতে পরতে। টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো ছাড়িয়ে চণ্ডী ঘোষ রোড আর চণ্ডীতলা অঞ্চল আমার সেই পাড়া।

নিজের পরিবারের বাইরে এ যেন আরও এক বৃহৎ পরিবার। কত পরিচিত মুখ, সম্পর্ক, ঘটনা আর স্মৃতি তাকে চিররঙিন করে রেখেছে।

প্রথমেই আজকের পাড়াটার কথা বলি। এখন চারদিক পরিচ্ছন্ন, ঝাঁ-চকচকে। নিয়মিত হয় রাস্তা পরিষ্কার, জঞ্জাল অপসারণ। ফলে যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে থাকে না আবর্জনা। প্রতিটি আলোকস্তম্ভে জ্বলে জোরালো আলো। তাই রাতেও পাড়াটা বেশ ঝলমলে থাকে। কাছাকাছি বেশ কিছু পার্কেও সংস্কারের ছাপ স্পষ্ট।

কাউন্সিলর মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায় ভালই কাজ করছেন। এলাকার মানুষের অভাব অভিযোগের কথা শুনে তিনি সমাধানেরও চেষ্টা করেন। সময়ের সঙ্গে উন্নত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ওয়্যারলেস পার্কে তৈরি হয়েছে কমিউনিটি হল। তাতে উপকৃত হয়েছেন এলাকার মানুষ। পাড়াটা এক কথায় নিরাপদ, নির্ঝঞ্ঝাট। অতি বৃষ্টিতেও এখানে জল জমে না। তবে আগের চেয়ে কমলেও এখনও আছে মশার উপদ্রব।

দমদম থেকে টালিগঞ্জ মেট্রো শুরু হওয়ার পর থেকেই দ্রুত বদলাতে থাকে অঞ্চলটা। জমি-বাড়ির দাম এখন আকাশছোঁয়া। গড়ে উঠলো ঘন বসতি, রাস্তার দু’ধারে তৈরি হল কত নতুন দোকানপাট। তবে দিনে দিনে পাড়ার বাইরের চাকচিক্য বাড়লেও হারিয়েছে অন্তরের টান আর সম্পর্কের উষ্ণতা।

আগে এ পাড়ায় সব ক’টি ছিল বাড়ি। এখন বহুতলের সংখ্যাই বেশি। সেই সঙ্গে পাড়ায় এসেছে কত নতুন মুখ। আক্ষেপ একটাই! পাড়ায় অনেকেই অপরিচিত থেকে যায়। পুরনো বাসিন্দাদের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা আজও রয়েছে। সুখে-দুঃখে আজও তাঁদের পাশে পাওয়া যায়। তবে নতুনরা কেমন যেন এড়িয়ে যান। আগে পাড়ায় নতুন কোনও পরিবার এলে পুরনোরা গিয়ে আলাপ করতেন। সমস্যায় সাহায্যের হাত বাড়াতেন। এ ভাবেই হত বন্ধুত্ব। আজ ছবিটা ভিন্ন। পাড়ায় কে এল, কে বা পাড়া ছেড়ে চলে গেল, এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। রাস্তায় দেখা হলে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলার প্রবণতাও কমেছে।

তবে বৃহৎ এই পাড়ার মধ্যে আরও একটি ক্ষুদ্র পাড়া আমাদের আবাসনটি। ছুটির দিনে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া কিংবা আড্ডা ধরে রেখেছে অন্তরঙ্গতা।

প্রথম সাইকেলে চড়া, সিগারেটের প্রথম সুখটান কিংবা প্রথম প্রেমে পড়া — সব কিছুই এ পাড়ায়। ছেলেবেলা ছিল অনেক সহজ-সরল। এক বন্ধুর বাড়ি সকালের জলখাবার খেয়ে, দুপুরে অন্য বন্ধুর বাড়ি খিচুড়ি খেয়ে স্কুলে গিয়ে আবার রাতের খাবারটাও কোনও এক বন্ধুর বাড়িতে খাওয়া কিছু অস্বাভাবিক ছিল না। পাড়াতুতো কাকা-জ্যেঠারা যেমন শাসন করতেন, তেমনই স্নেহপ্রবণও ছিলেন। তখন মাঝেমধ্যেই সন্ধ্যার পরে পাড়াটা ঝুপ করে ডুব দিত লোডশেডিং-এর অন্ধকারে। অবাক হয়ে দেখতাম পাড়ার আনাচ-কানাচে মনের সুখে ডানা মেলত সহস্র জোনাকি।

মাঝেমাঝে ভেবে অবাক হই ছোটদের খেলাধুলোর অভ্যাসটা অনেকটাই কমেছে। হয়তো আজকের বাবা-মায়েরা চান না তাঁদের ছেলে-মেয়েরা ধুলো-বালি মাখুক। তাই মাঠগুলো আজ ফাঁকাই পড়ে থাকে। মনে পড়ে, এক দিন না খেললে মনটা কেমন ছটফট করত। স্কুল থেকে ফিরে কোনও ক্রমে ব্যাগটা বাড়িতে রেখে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর মাঠে কিংবা ভরাট মাঠে খেলতে ছুটতাম। আগে এই সব মাঠে নিয়মিত হত ক্রিকেট, ফুটবল ট্যুর্নামেন্ট। তা নিয়ে আশপাশের মানুষেরও উৎসাহ কম ছিল না। তখন খেলাধুলোই তো ছিল জীবনের অন্যতম বিনোদন। আজকের মতো টিভির পর্দায় হাজারো বিনোদন কিংবা স্মার্টফোন, ওয়্যাটসঅ্যাপের আকর্ষণে বুঁদ হয়ে থাকত না ছেলে-বুড়ো সকলে।

ফিকে হয়ে এসেছে পাড়ায় সংস্কৃতি পরিমণ্ডলটা। এক সময়ে পাড়ার মানুষকে নিয়ে মঞ্চস্থ করা হতো নানা ধরনের নাটকও। তেমনই কত খ্যাতনামা শিল্পী এক সময়ে পাড়ার জলসায় আসতেন। সে সব আজও শুধুই স্মৃতি।

আমাদের পাড়াটা স্টুডিও পাড়া। রয়েছে নিউ থিয়েটার্স, টেকনিশিয়ান স্টুডিও, কলকাতা মুভিটোন স্টুডিও। ছোট থেকেই আগ্রহ ছিল অভিনয়ের প্রতি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটি ছবিতে একটি ছোট ছেলের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন উত্তমকুমার। যদিও ছবিটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। এখানেই দেখেছি বাংলা চলচ্চিত্রের বহু অভিনেতাকে। আমাদের প্রজন্মের অনেকেই এ পাড়ায় থাকলেও কিন্তু আগামী প্রজন্মের বেশির ভাগই পাড়ার বাইরে থিতু। তাঁদের অভিভাবকেরা এখন নিঃসঙ্গতায় দিনযাপন করছেন।

পাড়ার পুজো মানে টালিগঞ্জ অগ্রগামী মাঠের পুজো, উদয়ন ক্লাবের পুজো, ভরাট মাঠের প্রগতি সংসদের পুজো। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে পুজোর জৌলুস। আমাদের আবাসনের পুজোটিও সমান আকর্ষণীয়। পাড়ার কিছু ক্লাবের উদ্যোগে হয়ে থাকে রক্তদান শিবার, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা।

রকগুলি হারিয়ে যাওয়ায় বদলেছে আড্ডার ছবিটা। এখন বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু মানুষকে আড্ডা দিতে দেখা যায়। আগে আমাদের আড্ডা বসত অনিলদার চায়ের দোকানে। সেই দোকানটা আর নেই। সেখানেই উনুনের ধোঁয়ায়, নিভু নিভু মৃদু আলোয় বসত জমাটি আড্ডা।

এক সময়ে কাছাকাছি থাকতেন কয়েক জন চিকিৎসক, যাঁরা রাতবিরেতেও রোগীর বাড়িতে যেতেন। দিনে দিনে কমেছে তাঁদের সংখ্যাও। অনেক বদলালেও হারায়নি পাড়ার সেই আবহাওয়াটা। হয়তো সেটাই এক মায়ার বন্ধনে ধরে রেখেছে আমাদের সকলকে।

লেখক ব্যবসায়ী

connection kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy