E-Paper

চিকিৎসকের অভাব পূরণে মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গী সমাজকর্মীরা

মনোরোগ চিকিৎসক ও মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে মূলত দু’টি ধরন দেখা যায়। তাৎক্ষণিক আবেগের বশে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেন। অন্য ক্ষেত্রে পরিকল্পনা চলে অনেক দিন ধরে।

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২৫ ০৯:৫৪

—প্রতীকী চিত্র।

শৈশবের যৌন নির্যাতনের ধাক্কার সঙ্গেই যুক্ত হয়েছিল পারিবারিক অবহেলা। পরে বৈবাহিক জীবনেও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন বছর তেত্রিশের এক তরুণী। ধীরে ধীরে মনে আসে আত্মহত্যার চিন্তা। ছেলের মুখ চেয়ে সামলানোর চেষ্টা করতে থাকেন তরুণী। কিন্তু চিন্তা পিছু ছাড়ে না। মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার শরণাপন্ন হওয়ার কোনও পথ তরুণীর কাছে ছিল না। তখনই তাঁর সহায় হয়ে ওঠেন এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার স্থানীয় কর্মীরা, যাঁরা ওই তরুণীরই সামাজিক পরিসরের মানুষ। তাঁদের সঙ্গে শুরু হয় তরুণীর দীর্ঘ কথোপকথন। তাঁর সমস্যা শুনে পরামর্শ দেন ওই কর্মীরা। নিয়মিত চেষ্টার পরে এখন তরুণী সুস্থ জীবন কাটাচ্ছেন। পার্লারে কাজ করার পাশাপাশি সাংসারিক জীবনেও ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

মনোরোগ চিকিৎসক ও মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে মূলত দু’টি ধরন দেখা যায়। তাৎক্ষণিক আবেগের বশে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেন। অন্য ক্ষেত্রে পরিকল্পনা চলে অনেক দিন ধরে। মৃত্যু ছাড়া আর বোধহয় কোনও পথ নেই— এমন চিন্তা গ্রাস করে। তীব্র মানসিক চাপে এই চিন্তা বাড়ে। তবে সেই চিন্তা যদি কিছু ক্ষণের জন্যও অন্য পথে চালিত করা যায়, তা হলে অনেককেই ফেরানো সম্ভব হয়। কারও সঙ্গে কথা বলা হতে পারে সেই উপায়।

কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন কথা বলা যাবে কার সঙ্গে? এখনও সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি বহুলাংশে অবহেলিত। যাঁরা মনোরোগ চিকিৎসক বা মনোবিদের কাছে যাচ্ছেন, তাঁরা ‘পাগল’, এমন ভাবনা কার্যত শিকড় গেড়ে রয়েছে বহু মানুষের মনে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের কারও জন্য সাহায্য চাইতেও সঙ্কুচিত হয়ে থাকেন মানুষ, সেখানে নিজের জন্য সাহায্য চাওয়া কঠিন। মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার এই ফাঁকটি পূরণের উদ্দেশ্যেই এগিয়ে এসেছেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার স্থানীয় সমাজকর্মীরা। সংস্থাটির ‘জনমানস’ প্রকল্পে এই কাজ চলছে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা।

কী ভাবে কাজ করছেন তাঁরা? অঞ্জলি নামে ওই সংস্থা সূত্রে জানা যাচ্ছে, কেউ নিজে সাহায্য চেয়েছেন। কাউকে আশাকর্মীদের মাধ্যমে শনাক্ত করা গিয়েছে। কখনও আলাপচারিতার মাধ্যমে সমাজকর্মীরা বুঝতে পেরেছেন, কারও মধ্যে আত্মহননের চিন্তা রয়েছে। প্রথমে তাঁরা চেষ্টা করেন কথা বলে ভরসার জায়গা তৈরি করতে। তার পরে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আচরণের পরিবর্তন বোঝা, তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বা বর্তমানে চিন্তা রয়েছে কিনা— তা শোনা, ঝুঁকির স্তর চিহ্নিত করা ও কথা বলে ওই ব্যক্তিকে আত্মহত্যার পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আনার প্রয়াস চলে। তাঁকে শান্ত হতে সময় দেওয়া হয়। পরিবারে, সমাজে তাঁর ভূমিকা ও দায়িত্ব, প্রিয় বিষয় নিয়ে আলোচনায় জীবনের গুরুত্ব বোঝান কর্মীরা। আশপাশ থেকে আত্মহত্যার উপকরণ সরিয়ে ফেলা বা প্রয়োজনে পরিজনেদেরও জানানো হয়। তাঁদের সহায়তা যথেষ্ট নয় মনে হলে চিকিৎসকের কাছে পাঠানোরও ব্যবস্থা হয়।

মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব জানাচ্ছেন, যেখানে ডিগ্রিপ্রাপ্ত চিকিৎসকের অভাব রয়েছে, সেখানে এমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা সরকারি পরিকাঠামোর ঘাটতি পূরণে সাহায্য করতে পারেন। তাঁরা একটা কথা বলার জায়গা, সহায়তা দিতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ যে মানসিক ভাবে অসুস্থ, সেটা বোঝার জায়গায় তাঁরা থাকেন। অনিরুদ্ধ বলেন, ‘‘এমন কর্মীরা চিকিৎসকের বিকল্প না হয়ে সহায়ক হওয়াই কাম্য। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, আর্টিকল ২১-এর অধীন জীবনের অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকার। আশা করছি, এর পরে সরকারি পরিকল্পনা আরও সদর্থক পথে চালিত হবে।’’

অঞ্জলির কর্ণধার রত্নাবলী রায় জানাচ্ছেন, পুরুলিয়া, বহরমপুর ও উত্তর দমদম এলাকায় কাজ শুরু হয়েছে ২০০৭ থেকে। তাঁদের কর্মীরা অন্তত ১০টি আত্মহত্যা ঠেকাতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের মানসিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় সব চেয়ে বড় ঘাটতি সমন্বয়ে। সরকারি হাসপাতাল ও সমাজকর্মীদের সহায়তা— দুই স্তরে সমন্বয়ের বড় অভাব। সমন্বয় ঠিক থাকলে দু’টি ব্যবস্থারই নিজস্ব ঘাটতি খানিকটা নিয়ন্ত্রণে থাকত। সরকারি পরিকাঠামোয় ঘাটতি থাকার চেয়েও বড় কথা, তা কী ভাবে দেখা হচ্ছে এবং বাকি প্রক্রিয়ায় ঘাটতি পূরণের চেষ্টা হচ্ছে কিনা।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mental Depression Mental Health Social Works

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy