একটা রাজ্যে ১১ জন শুধু শব্দ-দাপটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বিভিন্ন সময়ে প্রাণ হারিয়েছেন। একটা রাজ্য, যা সারা দেশকে ‘বন্দি-শ্রোতা’-র (ক্যাপটিভ লিস্না্র) মতো শব্দবন্ধ দিয়েছে। যে শব্দবন্ধ মান্যতা পেয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছ থেকেও। সেই রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গে চলতি বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার ঘিরে যা চলছে, তা পরিবেশবিদ, সাধারণ মানুষের কথায়— ‘শব্দ-সন্ত্রাস’!
যে ‘সন্ত্রাস’-এর কারণে শহরের কোনও এক প্রান্তের এক পড়ুয়া আকুল আর্তি জানাচ্ছেন পরিবেশ সংগঠনগুলির কাছে, যাতে তিনি পড়তে পারেন। কারণ, সামনেই পরীক্ষা। কিন্তু কানের পাশেই প্রবল ভাবে মাইক বাজছে। আবার শহরের আর এক প্রান্তে ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় এমন ভাবে মাইক বাজানো হয়েছে যে, কাজকর্ম সব গুটিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। আবার অন্য জায়গায় লাগামছাড়া শব্দের কারণে নিজের বসতবাড়ি ছাড়বেন কি না, এমন দোলাচলে ভুগছেন বর্ষীয়ান পরিবেশকর্মী।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, রাজ্য জুড়ে শব্দ-ত্রাসের যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তারই প্রতিফলন এই ঘটনাগুলি। এক পরিবেশকর্মীর কথায়, ‘‘এগুলি বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন মাত্র। শব্দ-বিধি বলে যে একটা বিষয় রয়েছে, সেটাই মনে হচ্ছে না। এমনটা নয় যে, আগে খুব মনে হত। কিন্তু এ বার মনে হচ্ছে, সব লাগাম ছাড়িয়ে গিয়েছে।’’
পরিবেশবিদ এবং সাধারণ মানুষের আরও প্রশ্ন, রাজনৈতিক দলগুলো কী ভাবে দায়িত্ববোধের কথা বলে, যেখানে নিজেরাই প্রতি পদে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে? অনেকে আবার এটাও বলছেন, আসলে পুলিশ তো ‘ক্রীড়নক’ মাত্র। রাজ্যের ক্ষমতাসীন শাসক দলই যেখানে শব্দ-আইনের পরোয়া করে না, সেখানে সেই আইন মানবে কে? মানতে বাধ্যই বা করবে কে? এ বিষয়ে জানতে কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তাকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। উত্তর দেননি মেসেজেরও।
যার পরিপ্রেক্ষিতে এক পরিবেশবিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, এ ব্যাপারে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে পুলিশ, সব পক্ষই যে আশ্চর্যজনক ভাবে চুপ, সেটাই আশ্চর্যের। তাঁর মতে, ‘‘আইন নিয়ন্ত্রণ ও প্রণয়নকারী সংস্থাগুলি শব্দ-বিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে চুপ থেকে পরোক্ষে এই অসুস্থ পরিবেশকেই সমর্থন করছে।’’
যে অসুস্থ পরিবেশ কিছু দিন আগে দমদম পার্কের একটি খেলা প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল। অভিযোগ, সেখানে এমন তারস্বরে মাইক বাজানো হয়, যেখানে কান পাতা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দা, পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘এ বারই শুধু নয়। এর আগেও একাধিক বার এ রকম ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ, প্রশাসনকে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। পর পর এ রকম ঘটনা যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে গিয়েছে।’’
চলতি মাসের শুরুতেই আবার হাওড়ায় এক অনুষ্ঠানে এমন ভাবে মাইক বাজানো হয় যে, যেখানে সামনে পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও বইয়ে হাত দিতে পারেননি পূজা মিত্র (নাম পরিবর্তিত)। পূজার কথায়, ‘‘বুঝতে পারছিলাম না কার কাছে যাব, কী করব।’’ শেষে পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর নম্বর জোগাড় করে সেখানে ফোন করেন পূজা। ওই সংগঠনের
তরফে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে বিষয়টি জানানো হয়। পর্ষদের তরফে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাময়িক ভাবে শব্দের দাপট কমে ঠিকই, কিন্তু তার পরে আবার যে কে সেই! ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত বলছেন, ‘‘রাজ্যে এটা কী চলছে? শব্দ-আইন, জাতীয় পরিবেশ আদালত—কোনও কিছুকেই মান্যতা দেওয়া হচ্ছে না।’’
একই শব্দ-ত্রাসের মধ্যে গত দু’দিন কাটাতে হয়েছে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তকে। হাওড়ার পঞ্চাননতলা রোডে একটি ক্রিকেট প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে এত জোরে মাইক বাজানো হয়েছে যে, এলাকা থেকে অন্যত্র গিয়ে থাকার কথা ভাবছেন বর্ষীয়ান এই পরিবেশবিদ। তাঁর কথায়, ‘‘এই এলাকায় মনে হচ্ছে আর থাকতে পারব না। কারণ কানের কাছে এ রকম মাইক বাজলে শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’’ হাওড়া পুলিশের এক শীর্ষকর্তাকে এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এ নিয়ে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি।’’
কিন্তু যাঁরা নিয়ম ভাঙছেন, তাঁরা শব্দ-বিধি মান্য করা ছাড়াই সভা বা অন্য যে কোনও অনুষ্ঠানের অনুমতি পাচ্ছেন কী ভাবে, সে উত্তর কারও কাছেই নেই!