পাশে আছি: ইফতারের আয়োজনে সাহায্যের হাত তরুণীর। হাওড়ার শিবপুরে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
পাশের বন্ধুর ফেজটুপিটা ধার নিয়ে নিজস্বী তুললেন শাড়ি পরা মহিলা। কেউ বা জিন্স, টি-শার্টের সঙ্গে ওড়না-আঁচল যা হোক কিছু দিয়ে মাথা ঢাকলেন।
প্রৌঢ়ত্বের সীমা ছুঁয়েও অনেকের জীবনেই এই প্রথম ইফতার-অভিজ্ঞতা। হাওড়ার শিবপুরের তস্য গলির অন্দরে তখন সান্ধ্য আজান শুরু হব হব করছে। একবালপুরের লক্ষ্মী মন্দিরের কাছেও ইফতার উপলক্ষে একাকার পাঁচমিশেলি জনতা। আমরা-ওরা, জাত-ধর্ম, মেয়ে-পুরুষের বেড়া ভেঙে রমজানি বিকেল যেন মিলনমেলা। ‘‘মুসলিমরা তাও হিন্দু পুজোপার্বণ দেখার অনেকটাই সুযোগ পান। কিন্তু বহু বাঙালি হিন্দুর ক্ষেত্রেই সহ-নাগরিক মুসলিমদের বিষয়ে কিছুই না-জেনে জীবন কেটে যায়!’’— বলছিলেন গান বাঁধার শিল্পী তথা সংস্কৃতি-গবেষক মৌসুমী ভৌমিক।
পড়শির অচিন সংস্কৃতিকে জানার, বোঝার তাগিদেই কয়েক বছর ধরে মেলামেশার ইফতার বা বিজয়া সম্মিলনীর আসরে শামিল হচ্ছে কলকাতা। নানা আঙ্গিকে, নানা প্রান্তে চোখে পড়ছে এই প্রয়াস। দিন কয়েক আগে লন্ডনের ফিনসবেরি মসজিদ চত্বরে রোজাদারদের সঙ্গে একাসনে বসে ইফতার করেন লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন। দু’বছর আগে ওই মসজিদ চত্বরেই চলন্ত ভ্যানসুদ্ধ ঢুকে এক দক্ষিণপন্থী শ্বেতাঙ্গ জঙ্গি হামলা চালিয়েছিল। প্রবীণ ব্রিটিশ নেতা করবিন সে দিন বার বার বলছিলেন, ‘‘আমাদের
বাচ্চারা যেন বৈষম্য আর ঘেন্নার বদলে এক সাতরঙা বৈচিত্র্যময় দুনিয়ায় বেড়ে ওঠে। তা না-হলে তাদের জীবনটাও ম্যাড়মেড়ে, একঘেয়ে হয়ে থাকবে।’’
লেখক-সম্পাদক সোমায়া আখতারের কন্যা বিহু, অভিনেত্রী দামিনী বসুর মেয়ে চিনি, লেখক সাদিক হুসেনের মেয়ে তরী শিবপুরের পিএম বস্তির গলিতে খেলছিল একসঙ্গে। একবালপুরে ইফতার শেষে বড়দের দেখাদেখি মাইক হাতে সুমনের গান ধরল দশ বছরের মরমিয়া! ‘পাশেই কারও একখানি হাত ধরো, পাশেই কাউকে তোমার বন্ধু করো!’ একটু আগে সিলেটের সৈয়দপুরের পির মাজিরুদ্দিনের গান শোনাচ্ছিলেন মৌসুমী। ‘আদি হইতে এক মাতা, তবে কেন ভিন্ন ভ্রাতা, আমি ভয়ে কাঁপি ভিন্নতারই ডরে।’
ভিন্নতার দেওয়াল ভেঙে এ দেশের পটভূমিতে বহু স্বরের ডাক অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টাগুলি কত জরুরি, তা-ও উঠে আসছিল নানা জনের কথায়! মোমিনপুরের বুড়ি মসজিদের ইমাম আশরফ আলি কাশমি বললেন, ‘‘শুধু নমাজ আদায় নয়, বিশ্বাসীদের জন্য বিভেদ ভুলে পড়শির পাশে দাঁড়ানোও ধর্ম।’’ একদা তাঁর বৃদ্ধ মা-বাবাকে রেখে হজে যাওয়ার সময়ে হিন্দু পড়শিরা কী ভাবে ভরসা দিয়েছিলেন, সে গল্পও শোনালেন ইমামসাহেব।
উপবাসরত রোজাদারদের জন্য ফল কাটতে শিবপুরে বাড়ির লক্ষ্মীপুজোর প্রসাদ কাটার বঁটি হাতেই স্থানীয় ক্লাবঘরে জড়ো হয়েছিলেন দূর্বা দে, মালবিকা ঘোষ, কেয়া মুখোপাধ্যায়, মঞ্জু ভট্টাচার্যেরা। সান্ধ্য আজানের পরে উপবাস ভঙ্গের মুহূর্তেও ক্ষুধার্তদের পাতে ঠান্ডা গোলাপিরঙা সরবত ঢালতে ব্যস্ত বহিরাগত কোনও তরুণ-তরুণী। কাছে-দূরে ছড়িয়ে থাকা ‘সুহৃদ’দের টুকটাক সাহায্যেই রীতিমতো মসৃণ প্রায় ৭০০ লোকের ইফতারের আয়োজন!
একবালপুরের সংগঠক সমাজকর্মী সাবির আহমেদ, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহম্মদ রিয়াজ়েরাও বলছিলেন, জীবনে কখনও ইফতারে থাকার অভিজ্ঞতা হয়নি, এমন বহু জন ‘পড়শিকে জানা’র এই অনুষ্ঠানে শরিক হতে চেয়েছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক তথা দেশপ্রিয় পার্কের পুজো সংগঠক দীপঙ্কর বসু, তথ্যচিত্র নির্মাতা কস্তুরী, কিংবা শহরের কন্নড়ভাষী স্কুলশিক্ষিকা মাধুরী কাট্টিদের কাছে এমন অনুষ্ঠান অবশ্য নিছকই কোনও অন্য রকম অভিজ্ঞতা নয়। মাধুরী বলছিলেন, ‘‘সবাই ভাল বা নিরাপদ থাকলেই আমরাও ভাল থাকব, এটা বলতেও এখানে এসেছি!’’
আগামী রবিবার লেকের মসজিদেও এমন একটি অভিনব ইফতারের ডাক দেওয়া হয়েছে। ‘গ্রিন ইফতার’-এর আহ্বানে সবাইকেই কিছু না-কিছু নিরামিষ খাবার সঙ্গে করে আনতে বলা হয়েছে। সবাই ভাগাভাগি করে চাখার আনন্দেই সে দিন রোজা ভাঙবে কলকাতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy