Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
বরো-৩

অটুট থাকবে কি বামের কেল্লা, এ বার তার পরীক্ষা

সাগরের মাঝে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো তৃণমূল বোর্ডের একমাত্র বাম বরো। একমাত্র বরো, যেখানে কংগ্রেস কাউন্সিলর রীতিমতো সরব সারদা-কাণ্ডে। খোদ মেয়রের দাবি নস্যাৎ করে দিচ্ছেন তাঁরই দলের প্রার্থীরা, সে-ও শুধু এই বরোতেই। এবং এই ত্র্যহস্পর্শেই পুরভোটের ময়দানে নজর কাড়ছে কলকাতা পুরসভার ৩ নম্বর বরো। তৃণমূলের পুরবোর্ডে বেলেঘাটা-উল্টোডাঙা-মানিকতলা জুড়ে থাকা এই বরোই এখনও বামেদের দখলে।

অনুপ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

সাগরের মাঝে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো তৃণমূল বোর্ডের একমাত্র বাম বরো। একমাত্র বরো, যেখানে কংগ্রেস কাউন্সিলর রীতিমতো সরব সারদা-কাণ্ডে। খোদ মেয়রের দাবি নস্যাৎ করে দিচ্ছেন তাঁরই দলের প্রার্থীরা, সে-ও শুধু এই বরোতেই।

এবং এই ত্র্যহস্পর্শেই পুরভোটের ময়দানে নজর কাড়ছে কলকাতা পুরসভার ৩ নম্বর বরো।

তৃণমূলের পুরবোর্ডে বেলেঘাটা-উল্টোডাঙা-মানিকতলা জুড়ে থাকা এই বরোই এখনও বামেদের দখলে। ন’টি ওয়ার্ডের মধ্যে শুধু তিনটি ওয়ার্ড ১৪, ৩০ ও ৩১ নম্বরে তৃণমূল। কংগ্রেসের দখলে ২৯ নম্বর ওয়ার্ড। বাকি ১৩, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫— পাঁচটি ওয়ার্ডই বামেদের হাতে। তাই ওই বরো করায়ত্ত করতে বাম কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে সব রকম ‘অস্ত্র’ প্রয়োগ করতে চায় তৃণমূল। তাঁরা বলছেন, এখানে বুস্টার পাম্পিং স্টেশনের শিলান্যাস করেছে তৃণমূল বোর্ডই। যা শুনে বামেদের পাল্টা দাবি, তাঁদের চাপেই ওই পাম্পিং স্টেশন করতে বাধ্য হয়েছে পুর-প্রশাসন। এ দিকে, তৃণমূল বনাম বামের যুদ্ধে এলাকাবাসীরা অনেকে মনে করছেন, একাধিক ওয়ার্ডে হারজিতের নির্ণায়ক হতে পারে বিজেপি। একটিমাত্র ওয়ার্ডে নিজেদের আসন দখলে রাখতে জোরকদমে লড়াই শুরু করেছে কংগ্রেসও।

২৯ নম্বরের কংগ্রেস ওয়ার্ড নজর কাড়ছে আর এক কারণেও। কারণটা সেখানকার কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায় নিজেই। পুরসভার অন্দর মহলের খবর, গত ৫ বছরে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নানা ভাবে ব্যতিব্যস্ত করেছেন প্রকাশবাবু। কখনও ত্রিফলা কেলেঙ্কারীর প্রতিবাদে, কখনও বা সারদা ইসুতে আটকে রেখেছেন মেয়রের ঘরে ঢোকার পথ, পুরভবন চত্বর। যা নিয়ে বিতর্কে অধিবেশন কক্ষেও প্রকাশবাবুর সঙ্গে হাতাহাতির উপক্রম হয়েছিল শাসকদলের এক কাউন্সিলরের। তাই উপাধ্যায়কে আর পুরসভায় দেখতে চান না মেয়র। মূলত সেই কারণেই ‘প্রকাশ বধ’-এ স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক পরেশ পালকে এই ওয়ার্ডে প্রার্থী করা হয়েছে— এমনটা মনে করছেন দলের নেতা কর্মীরাও। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই ওয়ার্ডে জল ঘোলা করতে বিজেপি-ও এখানে মহম্মদ মোক্তারকে প্রার্থী করেছে। রয়েছেন বামপ্রার্থী পেশায় চিকিৎসক সুদীপ্তা দাসও, যিনি প্রাক্তন কাউন্সিলর সুবোধ দে-র মেয়ে।

পুরভোটের মুখে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলছেন, কলকাতার ৯৫ শতাংশ মানুষের কাছে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিয়েছে তাঁর বোর্ড। সেই জলের দাবিতে অবশ্য চোনা ফেলেছেন তাঁরই দলের প্রার্থীরা। ৩ নম্বর বরোয় সাবেক কলকাতার কিছু ওয়ার্ডে ভোট চাইতে গিয়ে তৃণমূলের ওই প্রার্থীরাই বলে আসছেন, পানীয় জলের সমস্যা প্রবল। বাম কাউন্সিলরেরা গত পাঁচ বছরে তা নিয়ে কিছুই করেননি। অথচ যে পাঁচ বছরে পানীয় জলের ওই সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ে ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল শাসিত পুরবোর্ডই। যার জেরে নানা মহলে প্রশ্নের মুখে খোদ মেয়রের কৃতিত্বের দাবিই। আর তাই নিয়েই জমে উঠেছে নির্বাচনী লড়াই।

৩২ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের প্রার্থী রূপা বাগচী। তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল নামিয়েছে প্রায় আনকোরা এক কর্মী শান্তিরঞ্জন কুণ্ডুকে। পুরসভার বিরোধী দলনেত্রীর বিরুদ্ধে কোনও হেভিওয়েট নেই কেন? তবে কি ওই আসনে স্বচ্ছন্দ নয় তৃণমূল? “মোটেই তা নয়।” জবাব এলাকার বিধায়ক তথা মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের। বরং তাঁর মন্তব্য, “রূপাদেবী তো বড় নেত্রী। লোকসভায় লড়েছেন। সিপিএমের রাজ্য সংগঠনে বড় দায়িত্ব পেয়েছেন। হয়তো পলিটব্যুরোতেও যাবেন। তাই এলাকায় সমস্যা মেটাতে শান্তির মতো লোককেই দরকার। প্রয়োজনে রাস্তা সাফও করতে পারবে।” যা শুনে রূপাদেবী বলছেন, “তেমন ঔদ্ধত্য আমার নেই। আর ওঁদের দলেও তো এমন কয়েক জন রয়েছেন, যাঁরা দলে অনেক দায়িত্বে থেকেও পুরসভায় লড়ছেন। আগে নিজের ঘর সামলান।” প্রচারে মূলত এই দুই দলের দাপট বেশি থাকলেও এই ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থী করেছে স্থানীয় প্রমোদ দাশগুপ্ত বস্তির বাসিন্দা পঙ্কজ বৈরাগীকে। প্রচারে দেখা যাচ্ছে না কেন? পেশায় গাড়িচালক পঙ্কজের অভিযোগ, “এমনিই প্রচারে পিছিয়ে। তার উপরে যেখানেই হোর্ডিং, ব্যানার লাগাচ্ছি, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খুলে দিচ্ছে বিরোধীরা। কত আর লড়াই করব বলুন। বুঝেছি জনগণই ভরসা।”

উল্টোডাঙা এলাকায় ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে এ বার তৃণমূূলের প্রার্থী আইনজীবী অনিন্দ্যকিশোর রাউত। দিনরাত ছুটে বেড়াচ্ছেন ভোটারের বাড়ি-বাড়ি। আরিফ রোডের বাসিন্দা মহেন্দ্র প্রজাপতির অভিযোগ, “বস্তিতে থাকি। পাতকুয়োর জল ব্যবহার করি। বর্ষায় নর্দমা এবং পাতকুয়োর জল মিশে যায়। বারবার জানিয়েও ফল হয়নি।” বর্তমান বাম কাউন্সিলরকে ছেড়ে এলাকা তাঁকে ভোট দেবে কেন? অনিন্দ্য বললেন, “এলাকার বেশির ভাগই বস্তি। অথচ বস্তি উন্নয়নে অনেক কাজ বাকি। কিছু জায়গায় জলও পৌঁছয়নি।” কিন্তু বোর্ড তো তাঁর দলের হাতেই। পুর-প্রশাসন করেনি কেন? অনিন্দ্যর জবাব, “পুর-বোর্ড তো টাকা দিয়েছে। কাজ করার দায়িত্ব তো কাউন্সিলরের। উল্টে এলাকার বিধায়ক সাধন পাণ্ডে কয়েকটি বস্তিতে শৌচাগার করে দিয়েছেন। জলের ব্যবস্থা করেছেন।” স্থানীয় বাম কাউন্সিলর বিরতি দত্তের জবাব, “ওঁদের কাজই তো বিরুদ্ধাচরণ করা। কী আর উত্তর দেব? এলাকার মানুষ জানেন, কী কাজ হয়েছে। ওয়ার্ডের জন্য তৃণমূলের কাউন্সিলর যে টাকা পেয়েছেন, আমরা তা পাইনি।” এমনকী ক্লাবগুলোকেও টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করেছে তৃণমূল, অভিযোগ বিরতিদেবীর।

৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে খালপাড়ে থাকেন সীমা নস্কর। পরিবারে সদস্যসংখ্যা ৮। বললেন, “সকাল থেকে জলের জন্য বসে থাকতে হয়। কবে এই দুর্দশা কাটবে জানি না।” ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরওয়ার্ড ব্লকের ঝুমা দাস। এ বার তাঁর বিরুদ্ধে লড়ছেন তৃণমূল নেতা অলক দাসের মেয়ে অলকানন্দা দাস। যোগেশচন্দ্র আইন কলেজের শিক্ষিকার পদ ছেড়ে ভোটে লড়ছেন অলকানন্দা। বাবার হাত ধরেই রাজনীতিতে। কেন তাঁকে ভোট দেবেন মানুষ, জানতে চাইলে তাঁর জবাব— “এলাকার প্রধান সমস্যা পানীয় জল। পুকুরের সংস্কার হয় না। পাশেই খাল। মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা।” তাঁর অভিযোগ, গত ৩০ বছরে বামেরা কিছুই করতে পারেনি। পুর-প্রতিনিধির গাফিলতিই এর প্রধান কারণ। যা নিয়ে ঝুমার বক্তব্য, “ও আমার ছোট বোনের মতো। রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা কম। নেতারা যা শেখাচ্ছেন, তাই বলছে।” উল্টে বরং আরও এক সমস্যার কথা শোনালেন ঝুমা, “বেআইনি নির্মাণ বাড়ছে। পুরসভার কাছে তালিকা জমা দিয়েও ফল মেলেনি।” শিয়ালদহ কোর্টের আইনজীবী বৈশাখী ঘোষাল বিজেপি প্রার্থী। বললেন, “বেলেঘাটার পরিবেশ সুস্থ নয়। প্রায়ই রাজনৈতিক লড়াইয়ে অশান্ত হয়ে ওঠে এলাকা। এর একটা সুষ্ঠু সমাধান জরুরি। প্রচারে মানুষের কাছে এই অভিযোগই শুনছি।” এরই সমাধানে কাজ করতে চান বলে জানালেন তিনি।

বরো চেয়ারম্যান রাজীব বিশ্বাস এ বারও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী। বললেন, “বরো ক্ষমতায় থাকলেও পুরবোর্ড আমাদের সঙ্গে বিমাতৃসুলভ আচরণ করে। তাই সমস্যা জেনেও কিছু করতে পারিনি।”

৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শিবেন দাস জানিয়েছেন, দিনে ৪০-৫০ গাড়ি জল এলাকায় আসত। এখন আর আসে না। গভীর নলকূপের জল খেতে হয়। সমস্যা মেনে নিয়েছেন ৩৩ এবং ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী পবিত্র বিশ্বাস এবং আশুতোষ ঘোষও। বড় রাস্তা সাফ থাকলেও অলিগলিতে জঞ্জাল সাফাই হয় না। বেহাল নিকাশিও। ওয়ার্ডে প্রচারে তাঁরা যে পিছিয়ে, তা স্বীকার করে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী কাশীনাথ বিশ্বাস বলেন, “দীর্ঘদিন এই এলাকায় ঘাঁটি গাড়া সিপিএম সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়েছে এলাকাবাসীর। আতঙ্ক রয়েছে তৃণমূল সম্পর্কে। মানুষ অবাধে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে পরিস্থিতি বদলাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE