সেনার মধ্যেই বাহিনীর ক্ষতি করতে মজুত একাধিক চর! সন্দেহভাজন আইএসআই এজেন্ট আখতার খান কলকাতায় বসে এই ব্যবস্থাই করেছিল বলে গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি।
কলুটোলা থেকে শনিবার ওই ব্যক্তিকে প্রায় পৌনে দু’লক্ষ টাকার ভারতীয় জালনোট-সহ গ্রেফতার করার পর তাকে দফায় দফায় জেরা করে গোয়েন্দারা জেনেছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন ও নর্থ ইস্টার্ন কমান্ড-এর কিছু গোপন নথি পাকিস্তানে পাচার করেছে আখতার। সেনাবাহিনীর ভিতরে কোনও লোক না থাকলে ওই ধরনের কাগজপত্র হাতে আসার কথা নয় বলে গোয়েন্দরা নিশ্চিত।
কলকাতা পুলিশের এসটিএফ-এর এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, ‘‘আখতার মোটা টাকা দিয়ে এমন কিছু লোক নিয়োগ করেছিল, যারা তার হাতে ওই সব নথি তুলে দিত। তারা কারা, সেটা আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।’’ এই ব্যাপারে সেনা গোয়েন্দারাও কলকাতা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে লালবাজারের এক সূত্রের খবর।
এসটিএফের এক তদন্তকারী অফিসারের বক্তব্য, ‘‘কেবল সেনা ছাউনি ও ঘাঁটিগুলির ছবি তুলে পাঠালে বাহিনীর ভিতরের কারও জড়িত থাকার আশঙ্কা কম ছিল। কিন্তু আখতার ওই সব ছবির পাশাপাশি ইস্টার্ন ও নর্থ ইস্টার্ন কমান্ড-এর এমন কিছু তথ্য পাঠিয়েছে, যেগুলো সাধারণ লোকের হাতে আসার কথা নয়। বাহিনীরই কেউ তাকে ওই সব সরবরাহ করত।’’
ওই সব গোপন নথি পাচার করা হত কী ভাবে?
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ই মেল মারফত ওই সব নথি পাচার করা হয়েছে পাকিস্তানে। আখতার তার ই-মেল অ্যাকাউন্ট থেকে পাঠানো প্রচুর মেল মুছে দিলেও সেগুলো ‘রিট্রিভ’ করা বা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে।
রবিবার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আখতারকে হাজির করানো হলে বিচারক তাকে ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগে মামলা রুজু করেছে পুলিশ।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এসআইবি জানাচ্ছে, এই সব নথি পাচার করার বিনিময়ে পাকিস্তান থেকে নিয়মিত মোটা টাকা আসত আখতারের কাছে। কী ভাবে? এসআইবি-র বক্তব্য, আখতারের কাছ থেকে পাকিস্তানের এইচবিএল তথা হাবিব ব্যাঙ্কের একটি ডেবিট কার্ড পাওয়া গিয়েছে। এবং সেটি দিয়ে দুনিয়ার যে কোনও প্রান্তে এটিএম থেকে নগদ তোলা যায়। আখতার যাদের হয়ে কাজ করত, তারা ওই ব্যাঙ্কের একটি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা ফেলে দিত। আর কলকাতায় এটিএম থেকে প্রয়োজন মতো টাকা তুলে নিত আখতার। প্রসঙ্গত, এইচবিএলের সদর দফতর পাকিস্তানের করাচিতে।
তবে গোয়েন্দাদের কাছে আখতার দাবি করেছে, তার জন্ম ভারতে ও শৈশবও সে কাটিয়েছে এ দেশে। আর ২০১১-তে নেপাল সীমান্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আইএসআইয়ের চর হিসেবে ঢোকার আগে ২০ বছর সে পাকিস্তানে কাটিয়েছে। তখনই সে চরবৃত্তির প্রশিক্ষণ নেয়। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বিহারেও আখতারের ছোটবেলা কেটেছে।
আবার পাক গুপ্তচর সংস্থার এই সন্দেহভাজন চাঁইকে গ্রেফতার করা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছে কলকাতা পুলিশের এসটিএফ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এসআইবি-র মধ্যে।
এসটিএফের বক্তব্য, গত সাত দিন ধরেই আখতারকে ‘নজরবন্দি’ করা হয়েছিল, তড়িঘড়ি গ্রেফতার না করে, তাকে অনুসরণ করে আইএসআইয়ের আরও কয়েক জন চরের সন্ধান পাওয়া যেত। কিন্তু এসআইবি খবরটা যে কোনও কারণে ফাঁস করে দেওয়ায় সব কিছু ভেস্তে গেল বলে এসটিএফ মনে করছে। শনিবার সন্ধ্যায় যখন খবরটি প্রথম সংবাদমাধ্যমে পৌঁছয়, তখনও আখতারকে গ্রেফতার করা হয়নি। কিন্তু কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা ছবি পর্যন্ত ফাঁস করে দেওয়ায় এসটিএফ আখতারকে শেষমেশ ‘গ্রেফতার’ দেখাতে বাধ্য হয়।
অন্য দিকে, এসআইবি বলছে, আখতারের দিদি জাহানারা গত মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর তিলজলা থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করে জানান, ৭ তারিখ থেকে তাঁর ভাইয়ের খোঁজ মিলছে না। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ওই দিনই আখতারকে আটক করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের মতে, সাত দিন ধরে এক জনকে গ্রেফতার না করে আটকে রাখাটা ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যেত।
এ দিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আখতারের আইনজীবী ফজলে আহমেদ খানও জানান, সাত দিন ধরে পুলিশ তাঁর মক্কেলকে বেআইনি ভাবে আটকে রেখেছিল, তার বাড়ির লোকজনকে কিছুই জানানো হয়নি এবং শনিবার রাতে তার গ্রেফতার হওয়ার খবর জানানো হল। তা ছাড়া, আখতারের কৌঁসুলি দাবি করেন, তাঁর মক্কেলের কাছ থেকে জালনোট কেবল উদ্ধারের কথা জানিয়েছে পুলিশ, কিন্তু জালনোট এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় পাচারের প্রমাণ মেলেনি। আখতার এক জন ভারতীয় নাগরিক বলেও ফজলে আহমেদ খান দাবি করেন। সরকারি আইনজীবী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানান, আখতারের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ভাবে প্রচুর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, নিখোঁজ ডায়েরিতে আখতার খানের ঠিকানা হিসেবে তপসিয়া রোডের কথা উল্লেখ করা হলেও আখতারের আধার কার্ডে তার ঠিকানা কলিন স্ট্রিট।