কলকাতা যাতে দিল্লি না হয়, তার জন্য এ বার নড়ে বসল নবান্ন।
গত বেশ কিছু দিন ধরেই এ শহর বাতাসের বিষের নিরিখে টেক্কা দিচ্ছিল দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাইকে। জাতীয় পরিবেশ আদালত সতর্ক করা সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি পরিবেশ দফতর। কলকাতার মানুষকে বাঁচাতে তাই এ বার উদ্যোগী হয়েছে নবান্ন।
বুধবার নবান্নে বৈঠক ডেকে মুখ্যসচিব দূষণকারী বিভিন্ন দফতরের কর্তাদের জানিয়ে দিয়েছেন, কলকাতার বাতাসকে আর বিষিয়ে দেওয়া চলবে না। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করা হচ্ছে বলে মুখ্যসচিব ওই বৈঠকে জানিয়েছেন। পরিবেশ দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, যুব বিশ্বকাপের প্রস্তুতির সময়ে কিছু সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়ায় সল্টলেকের বায়ুদূষণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা গিয়েছিল। স্থায়ী ভাবে এমনটা করা যায় কি না, সেই প্রশ্ন তখনই উঠেছিল। বুধবার নবান্নের বৈঠকেও এ বিষয়টি উঠেছিল বলে সূত্রের খবর।
নবান্নের খবর, মুখ্যসচিবের বৈঠকে পরিবেশ, পরিবহণ, পূর্ত, নগরোন্নয়ন দফতর এবং কলকাতা ও হাওড়া পুরসভার প্রতিনিধিরা ছিলেন। সেখানে বলা হয়েছে, নিয়মিত বাতাসের বিষ মাপতে হবে এবং দূষণের সম্ভাব্য উৎসগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বস্তুত, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং জাতীয় পরিবেশ প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা (নিরি) যৌথ ভাবে কলকাতায় দূষণের উৎস মাপছে (যদিও এ মুহূর্তে যন্ত্র খারাপ)। কিছু দিনের মধ্যেই নিরি প্রাথমিক রিপোর্ট জমা দিতে চলেছে। সেই রিপোর্ট থেকে একটা দিশা মিলবে বলেই মনে করছেন পরিবেশ দফতরের বিজ্ঞানীরা।
তবে এই সমীক্ষা নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে। পরিবেশ দফতরের খবর, কলকাতায় এত দিন মাপা হলেও হাওড়ার বাতাসের দূষণ মাপা হচ্ছে না। তার কারণ, নিরিকে হাওড়া পুরসভা পর্যাপ্ত জায়গা দিতে পারেনি। পরিবেশকর্মীদের একাংশ বলছেন, হাও়়ড়ার দূষণ কিন্তু কলকাতার ক্ষতি করে। পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার যে, রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক দফতর কিন্তু এখন মহাকরণ নয়, হাওড়ার নবান্ন।
কী কী ব্যবস্থা নিয়ে দূষণ কমানোর কথা বলা হয়েছে বুধবারের বৈঠকে?
প্রশাসন সূত্রের খবর, ঠিক হয়েছে, সব বড় মাপের নির্মাণস্থল ঢেকে রাখতে হবে। বিভিন্ন নির্মাণস্থলে ইমারতি সামগ্রী খোলা নয়, ঢেকে রাখতে হবে। ভাঙাচোরা রাস্তাগুলিকে অবিলম্বে সারাতে হবে। গা়ড়ির দূষণ পরীক্ষা কেন্দ্রগুলিকে নিয়ে পরিবেশকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ জানান। সেগুলিতে যে গলদ রয়েছে এবং তার ফলে দূষিত গাড়ি ছাড়পত্র পাচ্ছে, তা-ও উঠে এসেছে বৈঠকে। স্থির হয়েছে, সেই সব গলদ দূর করতে হবে এবং এই কেন্দ্রগুলিকে অবিলম্বে নজরদারির আওতায় আনতে হবে।
এ ছাড়া শহরে কাঠ, কয়লার মতো জ্বালানি নিষিদ্ধ হলেও তা সব জায়গায় মানা হয় না। সেই ত্রুটিও ঠিক করতে হবে। পরিবেশকর্মীদের অনেকেই বলছেন, ইদানীং পাড়ায় পাড়ায় রুটি এবং ইস্ত্রির দোকানে কয়লার উনুন ব্যবহার করা হয়। অফিসপাড়ার বিভিন্ন ফুটপাথের খাবার দোকানেও কয়লার উনুন জ্বলে। সেগুলিকে বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন এলাকায় জঞ্জাল পো়ড়ানো হয় এবং শীতকালে কাঠ, টায়ার জ্বেলে আগুন পোহান অনেকে। সেগুলিও বন্ধ করতে হবে।
যদিও পরিবেশকর্মীদের একাংশ বলছেন, সরকার ফুটপাথের দোকানে কয়লার উনুন বন্ধ করতে উদ্যোগী। কিন্তু প্রশাসনের ঠিকাদারেরাই তো রাস্তা সারানোর জন্য কাঠ, টায়ার জ্বেলে বেআইনি ভাবে পিচ গলান। সে দিক থেকে তো সরকারই বেশি দূষণে অভিযুক্ত। সরকারি ভাগাড়ে নিয়মিত আগুন জ্বলে। কেন সে দিকে কড়া নজরদারি রাখা হবে না? পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত কলকাতার বায়ুদূষণ নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। সেখানে এই বিষয়গুলিও তুলে ধরেছেন তিনি। সুভাষবাবু বলছেন, ‘‘পরিবেশ দূষণ কিন্তু আমজনতার পাশাপাশি প্রশাসনের কর্তাদেরও রেহাই দেয় না। আশা করব, এই সব সিদ্ধান্ত গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর করা হবে।’’ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘পর্ষদ, পরিবেশ দফতর, পরিবহণ দফতর, পুরসভা, পূর্ত দফতর— এরা নিজেরা নিজেদের কাজ করলেই দূষণ ঠেকানো সম্ভব। আমরা তো এই সব দাবি নিয়ে বহু দিন ধরেই সচেষ্ট।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy