লেলিহান: কোনও রকমে নেমে এসে নিজের অফিসকে এ ভাবেই জ্বলতে দেখছেন দেবশঙ্কর প্রামাণিক (সাদা জামায়)। সোমবার রাতে, স্ট্র্যান্ড রোডে। ছবি: নিজস্ব চিত্র ও রণজিৎ নন্দী
ভাগ্যিস, রেলের সরঞ্জাম মেরামতির ল্যাবরেটরির ঘরে ধোঁয়াটা চোখে পড়েছিল। তখন অফিস থেকে বেরোনোর সময় হয়ে গিয়েছে। সিএসটিই-র (চিফ সিগন্যাল টেলিকম ইঞ্জিনিয়ারিং) সাহেব সবে ঘর বন্ধ করে বেরিয়েছেন। আর কয়েক মিনিট বাদে আমরাও অফিস থেকে বেরিয়ে যেতাম। তার আগেই কালো ধোঁয়া চোখে পড়ল।
নিউ কয়লাঘাট বিল্ডিংয়ের ওই তেরোতলায় তখন প্রচণ্ড হাওয়া চলছে। আমরা চেঁচিয়ে উঠি! ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার তখনও ঘরে রয়েছেন। ওঁরা বেরিয়ে আসেন। দমকলে খবর দেন। কিন্তু হাওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। ধোঁয়ায় ভিতরে থাকা যাচ্ছিল না। ভিতরটা অন্ধকার। আগুন জ্বলছে বলেই লিফটে নামার সাহস পাইনি। ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার মহম্মদ নাসিরকে সঙ্গে নিয়েই আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করছিলাম। ওঁর বয়স হয়েছে। উনি আমাদের ধরে ধরে নামছিলেন।
পাঁচ বছর হল এই অফিসে কাজ করছি। পিওনের অস্থায়ী কাজ। এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা কখনও দেখিনি। আমার সঙ্গে ছিলেন নিতাইচন্দ্র সেন নামে দাদার মতো আর এক সহকর্মী। উনি দেড় বছর চাকরি করছেন। ওই বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই তেরোতলায় আমাদের অফিস ও বারোতলায় রেল সুরক্ষা আয়োগের অফিস আগুনে ভয়ানক তেতে উঠেছিল। তখনই খুব কষ্ট হচ্ছিল। দমকলকর্মীরা কী করে ওই আগুনের মধ্যে ঢুকছেন! দেখেই ভয়ে শিউরে উঠেছিলাম! পরে ট্রেনে বাড়ি ফিরে টিভিতে দেখেছি, দমকল ও পুলিশের কত জন মারা গিয়েছেন।
বাইরে বেরোনোর পরে স্ট্র্যান্ড রোডে দাঁড়িয়ে দেখলাম, চোখের সামনে জ্বলছে আমাদের গোটা অফিস। তখন বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল। নীচে দাঁড়িয়েই দেখলাম, ওই তো, সিএসটিই সাহেব ডি বি সিংহের ঘরটায় আগুন ধরে গেল। তত ক্ষণে আমরা ওঁকে গাড়িতে তুলে দিয়েছি। নীচে নামার পরে এক ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। কিন্তু তখনও একেবারে নীল রঙা আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। দেখে দমকলের লোকেরা বলাবলি করছিলেন, আগুনের উৎসেই নাকি তখনও পৌঁছনো যায়নি।
কাজটা যে বেশ কঠিন, তা বুঝতে পারছিলাম। রেলের ওই বাড়িতে কমিশনার অব রেলওয়ে সেফটি ও আরপিএফের অফিস রয়েছে। একতলায় রেলের টিকিট বুকিং হয়। ওই বাড়িতেই ‘সেন্টার ফর রেলওয়ে ইনফর্মেশন সিস্টেম’-এর অফিস। শুনেছি, রেলের বুকিংয়ের সব নথি ওই বাড়িতেই থাকে। তখনও জানি না, সব ঠিক আছে কি না!
আমার বাড়ি কোন্নগরে। সহকর্মী নিতাইদার বাড়ি উত্তরপাড়ায়। বারোতলা থেকে সাহেবকে ধরে ধরে নামানোর সময়ে ভাবছিলাম, বেরোতে পারব তো! কলকাতায় বড়বাজার, পোস্তায় অনেক বড় বড় আগুনের কথা শুনেছি। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। আমার পাঁচ এবং তিন বছরের দু’টো মেয়েকে আবার দেখতে পাব তো, বার বার এটাই মনে হচ্ছিল। পরে নেমে খবর পেয়েছি, রেলের টেন্ডারের এক সাহেবের নাকি মুখ ঝলসে গিয়েছে। আমরা ওই বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে শুনলাম, অন্তত জনা কুড়ি তখনও অফিসের ভিতরে। আরও বেশি লোক ভিতরে থাকলে কী যে হত, ভাবলে পাগল হয়ে যাব। বাড়ির বিষাক্ত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে মনে হচ্ছিল, স্রেফ শ্বাস নিতে পারার মধ্যেই কী শান্তি! এতগুলো লোক অফিসে আগুন নেভাতে মারা গেল। আজ রাতে দুশ্চিন্তায় আর ঘুম আসবে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy