Advertisement
০২ মে ২০২৪
সিন্ডিকেট-পাড়া

শান্তির মুখোশ, রাজত্ব ত্রাসেরই

টিনের চালের নীচে বেঞ্চ বসানো খুপরি অফিসগুলো মোটের উপরে খালি। চারদিকের ঘাসফুল পতাকাগুলোও হাওয়া। অফিসগুলোর সামনে সার দিয়ে দাঁড়ানো বাইকের জমায়েতও উধাও।

নিউ টাউনে চলছে নির্মাণকাজ।  ছবি :শৌভিক দে।

নিউ টাউনে চলছে নির্মাণকাজ। ছবি :শৌভিক দে।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায় ও কাজল গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৬ ০১:২৮
Share: Save:

টিনের চালের নীচে বেঞ্চ বসানো খুপরি অফিসগুলো মোটের উপরে খালি। চারদিকের ঘাসফুল পতাকাগুলোও হাওয়া। অফিসগুলোর সামনে সার দিয়ে দাঁড়ানো বাইকের জমায়েতও উধাও। এমনকী পাড়ায় পাড়ায় নির্মাণস্থলের আশপাশ দাপিয়ে বেড়ানো, হুমকি দেওয়া বাইক-বাহিনীরও দেখা নেই। সিন্ডিকেট পাড়া তো বটেই, রাজারহাট-নিউ টাউনের পুরোটা জুড়ে সাদা চোখে ছবিটা আপাতত এ রকমই। শান্তির।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া নির্দেশের পরেই সিন্ডিকেট-দৌরাত্ম্য বন্ধে সক্রিয় হয়েছে পুলিশ। বিধাননগরের কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়-সহ একাধিক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছেন। তার পর থেকেই ছবিটা পাল্টেছে রাজারহাট-নিউ টাউনে। পুলিশের দাবি, সিন্ডিকেট পাড়ার ছোট-বড় মাস্তান-তোলাবাজেরা অনেকেই ‘আন্ডার গ্রাউন্ড’।

তবে সাদা চোখে চেহারাটা যা-ই হোক, সল্টলেক থেকে রাজারহাট— সর্বত্রই ঘুরেফিরে আসছে একটা ছবি। হয় প্রশাসন সক্রিয় হওয়ার আগেই ‘চুক্তি’ হয়েছিল সিন্ডিকেটের সঙ্গে। গোলমালের ভয়ে বা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় তাদের থেকে মাল নেওয়াই চালিয়ে যাচ্ছে নির্মাণ সংস্থা। ফের রমরমা ফিরলে সিন্ডিকেটের ‘দাদা’রা ছেড়ে কথা বলবে না— সেই ভয়েও অনেকেই স্থানীয় সিন্ডিকেটের থেকেই নিচ্ছেন ইমারতি দ্রব্য। কেউ কেউ তাই বলছেন, শান্তির মোড়কটা উপরেই। তলে তলে এখনও দিব্যি লাভের কড়ি গুনছে সিন্ডিকেট।

অনিন্দ্যের গ্রেফতারির দু’দিন পরেই সেক্টর ফাইভে নাবার্ড অফিস বিল্ডিং তৈরির সময়ে হুমকি দেয় স্থানীয় একদল যুবক। ধরপাকড়ও হয়। ফের কাজ শুরু হয়েছে। ইমারতি দ্রব্য সরবরাহে কেউ আসেনি বলেই দাবি নির্মাণকারীদের। যদিও স্থানীয় একাধিক প্রকল্পের কর্মীদের কথায়, ‘‘এখন কেউ বিরক্ত করছে না। কিন্তু আমরা ইমারতিদ্রব্য আনলে সমস্যা বাড়বে। তাই যারা দিত, তারাই দিচ্ছে।

সাপুরজী এলাকার কেন্দ্রীয় প্রকল্পের ঠিকাদারেরা আবার বলছেন, ‘‘রেডিমিক্স বাইরে থেকে আনি। কিন্তু সিন্ডিকেটের লোক বলেছে, নির্মাণস্থলেই রেডিমিক্সের প্লান্ট তৈরি করতে। হয় সিন্ডিকেট থেকেই পাথর, বালি নিতে হবে। বা বাইরে থেকে কেনা রেডিমিক্সের দামের সমপরিমাণ টাকা দিতে হবে।’’ এমন সমস্যার কথা উঠে এসেছে রাজারহাটের বিষ্ণুপুর, চাঁদপুর, হুদারআইট থেকেও।

রাজারহাটের ব্যবসায়ীদের দাবি, ইমারতি দ্রব্য সরবরাহকারীদের ব্যবসার অনুমতি দিয়েছে প্রশাসন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসা চলে গায়ের জোরে। মাথায় থাকে রাজনৈতিক ছাতা। এ ভাবে সিন্ডিকেট গড়ে বিপুল লাভ করছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ। এখন রাতারাতি সংশোধন করতে গেলেও তারা সরবেন না। এমনিতেও নিউ টাউন থেকে রুইস মণ্ডল ছাড়া তেমন কোনও বড় সিন্ডিকেট চাঁইকে ধরতে পারেনি পুলিশ। সিন্ডিকেট সাম্রাজ্যের মাথায় থাকা সইফুল ইসলাম, ভজাই সর্দার, মাটি গফফর, মিনি গফফর, মোজাম্মেলরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের লোকজন অনেকেই কার্যত বহাল তবিয়তে ঘুরছে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক শিবির বদলে অনেকেই দিব্যি আছেন। এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘জুলুমের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে কেউ সিন্ডিকেটের দাবি না মানলে। না হলে সবই শান্ত।’’

ব্যবসায়ীদের অনেকেরই প্রশ্ন— প্রশাসনের কড়া নজরে না হয় এখন ‘জুলুমবাজি’ বন্ধ। কিন্তু তা ক’দিন? সাময়িক হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ চাইলেও নতুন করে অন্য কোথাও থেকে নির্মাণ সামগ্রী আনতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ব্যবসায়ীরা।

ভিন্ন মতও আছে। দু’এক জন ব্যবসায়ীর দাবি, সিন্ডিকেট-চাঁইরা এলাকা ছাড়া হওয়ায় তাঁরা ইচ্ছেমতো জায়গা থেকেই পাথর, বালি আনছেন। সল্টলেকের ব্যবসায়ী ললিত প্রহ্লাদকর যেমন বলেন, ‘‘পরে কী হবে জানি না। এখন সিন্ডিকেটের দাপট নেই। নিজেরাই বালি, পাথর জোগাড় করতে পারছি। মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। প্রশাসন এমন পদক্ষেপ জারি রাখলে রাজ্যের শিল্পের ছবিটা বদলাবে। বিনিয়োগ বাড়বে।’’

অধিকাংশ ক্ষেত্রে যদিও ভয়ের ছবিটাই বহাল। সংযুক্ত এলাকা সুকান্তনগরে যেমন পরপর নির্মাণ চলছে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, পুরভোটের পরে দৌরাত্ম্য বেড়েছে। স্থানীয় ও বহিরাগত ব্যবসায়ীদের এক এক রকম তোলা দিতে হচ্ছে। উপরন্তু কার থেকে ইমারতি দ্রব্য কী দামে নিতে হবে, তা-ও নির্দিষ্ট। যদিও সুকান্তনগরে আবাসন নির্মাণকেই বেআইনি দাবি করে বিধাননগর পুরনিগমের মেয়র সব্যসাচী দত্ত বলেন, ‘‘ওই সব বেআইনি নির্মাণের কথা পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর, একাধিক দফতরের মন্ত্রী, জেলাশাসক স্তরে লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে। এর পরে প্রশাসনের নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে।’’

সিন্ডিকেটের একটি অংশের অবশ্য দাবি, পুলিশের ভয়ে অধিকাংশ সদস্য পাড়াছাড়া। দৌরাত্ম্য বন্ধের নামে স্থানীয় যুবকদের জেলে না ভরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় নির্দেশিকা ঠিক হোক। তা না মানলে ব্যবস্থা নিক প্রশাসন।

বিধানসভা ভোটের আগে সিন্ডিকেটের হয়ে সওয়াল করার প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ‘‘বাম আমল থেকে সিন্ডিকেট চলছে। বহু যুবকের তা একমাত্র রোজগার। সেটা বলেছিলাম। এখন কী করা হবে, তা প্রশাসন বলবে। আমার কাজ পুর-পরিষেবা দেওয়া।’’

ব্যবসায়ী মহলে অবশ্য ঘুরছে আর একটি অভিযোগও— ধরপাকড় যা হচ্ছে সবই সল্টলেক, রাজারহাট বা নিউ টাউনে। বাইরে সিন্ডিকেট স্বমহিমাতেই। যত দিন না রাজ্যের সর্বত্র, স্থায়ী ভাবে সিন্ডিকেটের শিকড় নির্মূল করা যায়, তত দিন আশঙ্কাটা থাকবেই, বলছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Syndicate Raj city
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE