Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মৃতদেহের অসম্মান যুগে যুগে, বলছে ইতিহাস

অবসরপ্রাপ্ত ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অজয় গুপ্তের মনে পড়ছে তাঁর চাকরি জীবনের গোড়ার কথা। ১৯৭০-এর দশকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে থাকাকালীন রেলে কাটা পড়া দেহ মফস্‌সল এলাকায় বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়াই ছিল দস্তুর। ‘‘সেই সব বন্ধ করতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি’’— বলছেন তিনি। 

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২০ ০৬:১৬
Share: Save:

এমন দৃশ্য আগেও দেখা গিয়েছে। একদা বিষ মদ-কাণ্ডে দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামে ভ্যানরিকশায় মৃতদের স্তূপের ছবি সঙ্গত কারণে নাগরিক সমাজের অনুভূতিকে আহত করে। তবে কোভিড-অতিমারির আবহে অজানা ভাইরাস নিয়ে ভয়ও মৃতদেহ, এমনকি মৃতপ্রায়দের নিয়েও নিষ্ঠুরতা বাড়িয়ে তুলেছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। গড়িয়া শ্মশানে দাবিদারহীন দেহগুলি কোভিড রোগীর নয় বলে সরকার জানালেও অতিমারির পরিস্থিতিতে যে কোনও দেহ নিয়েই একটা আতঙ্ক মৃতদেহ সরানোর কাজে যুক্ত কর্মীদের ভিতরেও কাজ করছে বলে কারও কারও অভিমত।

অবসরপ্রাপ্ত ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অজয় গুপ্তের মনে পড়ছে তাঁর চাকরি জীবনের গোড়ার কথা। ১৯৭০-এর দশকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে থাকাকালীন রেলে কাটা পড়া দেহ মফস্‌সল এলাকায় বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়াই ছিল দস্তুর। ‘‘সেই সব বন্ধ করতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি’’— বলছেন তিনি।

এর পরেও নানা বড়সড় বিপর্যয় বা দুর্ঘটনার সূত্রে মৃতের অমর্যাদার প্রশ্ন উঠেছে বার বার। ২০১১-য় আমরি হাসপাতালে আগুন লেগে, বিষাক্ত ধোঁয়া ঢুকে ঘুমের মধ্যে ৯২ জনের মৃত্যুর সময়েও ভিতরে নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহ কারও কারও কাছে বিভীষিকার স্মৃতি হয়ে আছে। ২০১০-এ ঝাড়গ্রামের কাছে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা-কাণ্ডেও ভাঙাচোরা ট্রেন সরিয়ে দেহাংশ উদ্ধার পর্যন্ত দু’দিন লেগে যায়। তখনও অসহায় পরিজনেদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় প্রশাসনকে। কিন্তু শহরের মধ্যে দাবিদারহীন গলিতপ্রায় দেহের ছবি এ ভাবে এত লোকের সামনে আগে উঠে আসেনি। হয়তো সে-জন্যই বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত সরব বলে অনেকেই মনে করছেন।

“আমাদের সংবিধানের ২১তম অনুচ্ছেদে রাইট টু ডিগনিটি বা মর্যাদার অধিকার কিন্তু শুধু জীবিত মানুষ নয়, মৃত্যুর পরে তাঁর দেহটির জন্যও প্রযোজ্য”— বলছেন হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। পঞ্জাবের জেলে ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা নিয়ে পরমানন্দ কাটারার মামলায় ১৯৯৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট এটাই বলেছিল। ফাঁসির পরেও দেহটির অমর্যাদা নিয়ে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়। ঘটনাচক্রে গড়িয়া শ্মশানে আঁকশি দিয়ে গলিতপ্রায় দেহ টানাটানির ছবি প্রকাশ্যে আসার সময়েই দেশের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার কোভিড রোগীর দেহ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অমানবিক আচরণের কথা তুলে ধরেন। পুদুচেরীতে দেহ সমাহিত করার জন্য গর্তে ছোড়ার নিন্দা করেছিলেন তিনি।

সভ্যতার বিকাশের পথে মৃতদেহের মর্যাদা বরাবরই স্পর্শকাতর বিষয়। ইলিয়াডের কাহিনিতে হেক্টরের দেহ টেনে-হিঁচড়ে উল্লাসের পরে তা আটকে রেখে একিলিসের মতো বীরও দেবতাদের কোপদৃষ্টিতে পড়েন। দুঃশাসন ও দুর্যোধনের মৃত্যুর পরে ভীমের আচরণও মহাভারতে নিন্দার্হ হয়েছিল। মহাভারতবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মনে করাচ্ছেন, গদাযুদ্ধে দুর্যোধনের উরুভঙ্গের পরে ভীম তাঁর মাথায় লাথি মারতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন স্বয়ং কৃষ্ণই তাঁকে তিরস্কার করেন, ‘‘একাদশ অক্ষৌহিণীর অধিপতি দুর্যোধনের তুমি রাজমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে পারো না।’’ নৃসিংহবাবু অবশ্য বীভৎস ছবি তুলে ছড়িয়ে দেওয়াও নিষ্ঠুর পীড়নমূলক প্রবণতা বলে মনে করেন। তবে তিনি বলছেন, “আমাদের সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে দর্শনীয়ম, শোভনমের তত্ত্বে বিশ্বাসী। তার সঙ্গে মৃতদেহের অমর্যাদা খাপ খায় না।” আবার এ দেশেই অস্পৃশ্য দলিত দুখীর দেহ সৎকারের টানাপড়েন নিয়ে প্রেমচন্দ, সত্যজিতের সদগতি উঠে এসেছে। মা অভাগীর দেহ সৎকার নিয়ে পুত্র কাঙালীর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা লিখেছেন শরৎচন্দ্র।

রাজ্যের এক পুলিশকর্তার অভিজ্ঞতা, “কোভিড-পরিস্থিতিতে যাঁরা ব্রাত্য তাঁরা আরও ব্রাত্য হয়েছেন। কোথাও মৃতপ্রায় বা কারও দাবিদারহীন দেহ পড়ে থাকলেও আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে।” আবার কোভিডে মৃত্যু নিয়ে টানাপড়েনে দেহ পড়ে থাকা থেকে শুরু করে মৃত্যুর শংসাপত্র লেখায় বিভ্রাটের অজস্র ঘটনাও মৃতের প্রতি অমর্যাদার নামান্তর বলেই অনেকের অভিমত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dead body respect Forensic Expert
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE