Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
FIFA World Cup 2022

কাপ-উন্মাদনায় ভেঙে খানখান প্রতিবন্ধকতার স্তব্ধতাও

এক ঝলক দেখলে মনে হতে পারে, এটা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা নয়, আর্জেন্টিনার কোনও শহর! দীর্ঘ খরা কাটিয়ে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতার আনন্দে এমনই উন্মাদনা দেখা গেল শহর জুড়ে।

আনন্দ: জয়ের হাসি। রবিবার, উত্তর কলকাতায়।

আনন্দ: জয়ের হাসি। রবিবার, উত্তর কলকাতায়। নিজস্ব চিত্র।

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৫৪
Share: Save:

রাত বারোটায় রাস্তা দিয়ে ছুটছেন মানুষ। হাতে আর্জেন্টিনার বিশাল বিশাল পতাকা। উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ট্র্যাফিক সিগন্যাল মানার বালাই নেই। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়া ট্যাক্সিচালকও নেমে এসে ‘মেসি মেসি’ চিৎকার জুড়েছেন। কান পাতা যাচ্ছে না বাজির শব্দে। যেন অকাল দীপাবলি চলছে। অনেকে আবার মাঝ রাস্তায় বিশ্বকাপের আদলে বানানো বিশাল কাঠামো রেখে গড়াগড়ি খাচ্ছেন!

এক ঝলক দেখলে মনে হতে পারে, এটা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা নয়, আর্জেন্টিনার কোনও শহর! দীর্ঘ খরা কাটিয়ে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতার আনন্দে এমনই উন্মাদনা দেখা গেল শহর জুড়ে। যা চলল গভীর রাত পর্যন্ত। মধ্য কলকাতায় এমনই একটি জয়োৎসবের মিছিলে হাঁটা যুবক বললেন, ‘‘আজ আর্জেন্টিনা ঘুমাবে না। আমরাও জেগে থাকব যতক্ষণ পারি।’’ আর এক সমর্থক বললেন, ‘‘৩৬ বছরের শাপমোচনে মারাদোনাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দেওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় কিছু হতে পারত না।’’

ফুটবল ঘিরে এমন উন্মাদনার ছবি এ দিন দেখা গিয়েছে দিনভর। পৌষের দ্বিতীয় দিনে তাপমাত্রার পারদ নেমেছিল ভালই। কিন্তু শহরের নানা জায়গায় গজিয়ে ওঠা ‘সাপোর্টার্স জ়োনে’ ফুটবল জ্বরের জেরে সেই ঠান্ডা সে ভাবে মালুমই হয়নি। ইএম বাইপাস থেকে সল্টলেক দত্তাবাদ রোডে ঢোকার মুখে কিছুটা জায়গা শনিবার রাত থেকেই ঘিরে নিয়েছিলেন স্থানীয়েরা। রবিবার বিকেল থেকে সেখানে শুরু হয়েছিল যজ্ঞ। আয়োজনের জেরে ওই রাস্তা দিয়ে যান চলাচলের গতি কিঞ্চিৎ মন্থর হয়ে যায়। সন্ধ্যায় ফাইনাল ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজার মুখেই যজ্ঞ ছেড়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ান পুরোহিত। দর্শকদের জন্য লাগানো টিভির স্ক্রিনে যজ্ঞের টিপ পরিয়ে বলেন, ‘‘কাপ নিশ্চিত। এমবাপে, জিরু হবে জিরো, মেসিই হিরো।’’ মুহূর্তে ঢাক-ঢোল বাজা শুরু হয় আশপাশে। ওইভবিষ্যদ্বাণীই মিলে যায় রাতগড়াতেই।

কলকাতার ফুটবল-পাগলদের সমর্থন পাওয়ার দিক থেকে ফ্রান্স বেশ খানিকটা পিছিয়েই ছিল। কোথাও আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকা নিয়ে দুপুরেই বেরিয়েছিলেন সমর্থকেরা, কোথাও মেসির কাটআউট হাতে চলছিল নাচ। মুখে নীল-সাদা রং মেখে ঘুরছেন অনেকেই। তাসা, ঢাক বাজিয়ে পাড়া ঘুরতেও দেখা গিয়েছে অনেককে। এর সঙ্গেই চলে মিষ্টিমুখ, ফুটবল নিয়ে ‘ড্রিবল’। বাইপাসে দেখা গিয়েছিল প্রিয় দলের সমর্থনে বেরিয়েছে শোভাযাত্রা। এর সব কিছুকেই কোথাও যেন ছাপিয়ে গিয়েছিল ফকির চন্দ্র লেনের চিত্র। উত্তর কলকাতার এই গলি-পথ রাতারাতি পরিচিত হয়েছে ‘ফিফা গলি’ নামে। দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা বিশ্বকাপ খেলা দেশগুলির পতাকা। একটি বাড়ির দেওয়ালে এতগুলি বছরে যাঁরা যাঁরা কাপ জিতেছেন, তাঁদের ছবি। ফাইনাল উপলক্ষে সেখানে রয়েছে হাতে তৈরি বিশাল আর্জেন্টিনার পতাকাও। পাড়ার ক্লাব সেজেছে রঙিন কাগজে। ওই পাড়ার বাসিন্দা সুবীর দলুই বললেন, ‘‘বিশ্বকাপ শুরুর মাসখানেক আগে থেকে আমরা পাড়া সাজিয়েছি। আজকের পরে আবার সব আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তার আগে মনেপ্রাণে চাই, প্রিয় দল কাপ পাক।’’ পাশেই দাঁড়ানো ওই পাড়ার আর এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘আমাদের এখানে ব্রাজ়িলভক্ত বেশি। কিন্তু যে মানুষটা ফুটবলকে এত কিছু দিয়েছেন, তাঁর হাতে শেষ পর্যন্ত কাপ উঠুক, এটাই চাই। এমবাপের বয়স পড়ে আছে। এই বিশ্বকাপটা মেসিরই হোক।’’ রাতে তাঁদেরই বলতে শোনা গেল, ‘‘যা চেয়েছিলাম পেয়েছি। এই বিশ্বকাপ সারা জীবন মনে থাকবে।’’

‘ফিফা গলি’ থেকে হাঁটা পথে ঢুলিপাড়াতেও ঝুলছে বিশ্বকাপের বিশাল কাটআউট, খেলা শেষে রাতে সেখানে পায়ে বল নাচাচ্ছেকয়েক জন কিশোর। স্থানীয় তরুণী তনিমা কর্মকারের কথায়, ‘‘আমি মেসির অন্ধভক্ত। উত্তেজনায় খেলা দেখতে পারিনি। শুধু প্রার্থনা করে গিয়েছি। শেষ বাঁশি বাজার পরে আর বাড়িতে বসে থাকতে পারিনি।

দুই দলের সমর্থকদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ দেখা গিয়েছিল বরাহনগরে। সেখানে দুই বন্ধু এক জন মুখে নীল-সাদা রংকরেছিলেন, তো অপর জন ফ্রান্সের প্রতীক আঁকিয়েছিলেন। খেলা শেষে ফ্রান্সের সমর্থক বললেন, ‘‘পিছিয়ে থেকে যে লড়াইটা ফ্রান্সকরেছে সেটাই বা কম কী! আর একটু হলেই স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাচ্ছিল। এমবাপের জন্য খারাপ লাগছে। তবে ওঁর বয়স কম, অনেক সুযোগ আসবে।’’

ম্যাচের তখনও বাকি কয়েক মিনিট। বল নিয়ে ছুটছেন মেসি। নাছোড় ফ্রান্সের খেলোয়াড়েরাও ছাড়ার পাত্র নন। ভবানীপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিশাল স্ক্রিনে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের। সমস্যা হতে পারে ভেবে আওয়াজ কমিয়ে রাখা হয়েছিল টিভির। গোল হতেই সেখানে একটি ছেলে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘‘মেসি মেসি মেসি...!’’ উপস্থিত অন্যদের গলাতেও একই নাম। অভিভাবকদের কারও কারও চোখে জল। মুহূর্তে মনে হয়, প্রতিবন্ধকতার স্তব্ধতাও ভেঙে যায় ফুটবল ঘিরে চিৎকারে। জয়োচ্ছ্বাসের যে চিৎকারে মিশে যায়বুয়েনোস আইরেসে, কাতার আর কলকাতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE