স্যাঁতসেঁতে বড় বড় কয়েকটি হলঘর। আলো বিশেষ ঢোকে না। দেওয়ালে কোথাও চিড়, তো কোথাও উঠে এসেছে সিমেন্টের আস্তরণ। দরজাগুলিও খুব শক্ত নয়। জোরে ধাক্কা দিলে যে কোনও সময়ে তা ভেঙে যেতে পারে। কোনও ঘরে ২০টি আবার কোনওটিতে ১৫টি শয্যা। যার এক-একটির আয়তন ৩ ফুট বাই ৪ বা বড়জোর ৫ ফুট। আর সেই একটিতে ঠাসাঠাসি করে শুয়ে ২ জন কিংবা ৩ জন মেয়ে।
এ রকমই কয়েকটি টিনের চাল দেওয়া ঘর, বাইরে খানিক ফাঁকা জায়গা এবং দু’টি পুকুর এই রয়েছে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত দুঃস্থ এবং অনাথ মহিলা আবাসিকদের হোমে। ঠিকানা ঠাকুরপুকুর এলাকার ৪৪ নম্বর মহাত্মা গাঁধী রোড। রাজ্যের ‘মাস এডুকেশন’ দফতরের সাহায্যপ্রাপ্ত এই হোমে গত মঙ্গলবার রাতে পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয় ন’বছরের আবাসিক প্রীতি দাসের। হোমের গাফিলতিতেই মেয়ের মৃত্যু হয়েছে বলে তার মা, লেক থানার পঞ্চাননতলার বাসিন্দা সরস্বতী দাস থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। ওই দিনের ঘটনার পরে হোমের ভিতরে ঢুকতেই ধরা পড়ে কিছু অনিয়মের ছবি।
এই হোমে বাইরে থেকে প্রাচীর ও বড় লোহার গেট থাকলেও পিছনে আলাদা কোনও দেওয়াল নেই। রয়েছে ২টি পুকুর। যার একটির পাড় টিন দিয়ে খানিক ঘেরা হলেও অন্যটিতে ঘেরা নেই। এমনই এক পরিবেশে থাকে ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১৩৭ জন আবাসিক। কিন্তু এত জন মহিলা থাকলেও নিরাপত্তারক্ষী বলতে কিছুই নেই। ফাঁকা জায়গায় নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া কী করে হোম চলে, শুনে অবাক খোদ সাউথ-ওয়েস্ট ডিভিশনের ডিসি রশিদ মুনির খান। প্রীতি দাসের মৃত্যু ঘটনার পরেই তিনি হোম-কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন।
হোমে মেয়েদের রাখার জন্য নেই পর্যাপ্ত ঘরও। বড় বড় চারটি হল ঘরে মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা। কোনও ঘরে শয্যাসংখ্যা ২০, কোনওটিতে বা ১৫টি। শুধু তাই নয়, হোমের মেয়েদের জন্য যেখানে রান্না হয়, সেই ঘরটিও খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। একজন রাঁধুনি থাকলেও বাকি কাজে আবাসিক মেয়েরাই সাহায্য করে।
হোমের ওই দুই পুকুরের মাত্র একটি খানিকটা ঘেরা থাকায় কেউ অসাবধান হলেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেমনটি হয়েছে মঙ্গলবার। যদিও হোমের তরফে জানানো হয়, এলাকায় জলের সমস্যা থাকাতেই সেগুলি পুরোপুরি ঘেরা হয়নি। হোম-কর্তৃপক্ষ জানান, সেপ্টেম্বর থেকে জলের পাম্প খারাপ হয়ে যায়। তাই শৌচ ও হাত-মুখ ধুতে পুকুরের জল ব্যবহার করতে হয়। এ দিকে আবাসিকদের বক্তব্য, তাঁরা এ ভাবে থাকতেই অভ্যস্ত। মঙ্গলবার রাতেও শৌচাগার থেকে প্রীতি হাত-মুখ ধুতে ওই পুকুরে নামে। পরের দিন সেখান থেকেই উদ্ধার হয় তার মৃতদেহ।
কিন্তু সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হোমের এমন দুরবস্থা কেন?
হোমের যুগ্ম-সম্পাদক ইনা চৌধুরী জানান, রাজ্যের ‘মাস-এডুকেশন’ দফতর থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত এই হোমে মেয়ে পিছু মাসিক অনুদান ১২৫০ টাকা করে। তাতেই খাওয়া-থাকা, জামাকাপড়, বইপত্র সবের ব্যবস্থা করতে হয় বলেই দাবি ইনাদেবীর। তিনি জানান, মেয়েদের পিছনে খরচের পরে হোমের অন্য খরচ চালানো সম্ভব হয় না। কিন্তু হোমের রক্ষণাবেক্ষণে তো অনুদান আসে! সে বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি তিনি। উল্টে ইনাদেবীর দাবি, হোমের নিরাপত্তায় কিছু কুকুর রয়েছে। রাতে সেগুলিকে ছেড়ে রাখা হয়। ফলে পুকুর সাঁতরেও কেউ ঢুকবে না। হোমের এই অব্যবস্থা নিয়ে অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি ‘মাস এডুকেশন’ দফতরের অধিকর্তা অপিতা বসু।