ট্যাংরা, বেহালার পরে এ বার কসবার হালতু। দিন পনেরোও পেরোয়নি, ফের বাড়ি থেকে একই পরিবারের তিন জনের দেহ উদ্ধার হল কলকাতায়। ঝুলন্ত স্ত্রীর পাশে আড়াই বছরের ছেলেকে বুকের সঙ্গে বেঁধে রাখা অবস্থায় ঝুলছিল স্বামীর দেহ। মঙ্গলবার সামনে আসা এই ঘটনাটি প্রাথমিক ভাবে আত্মহত্যা বলে মনে করলেও এর পিছনে কারও ইন্ধন রয়েছে কিনা, নির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করে তার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। গ্রেফতারও করা হয়েছে দু’জনকে। যদিও পর পর এমন ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, তবে কি ‘কপিক্যাট সুইসাইড’ (অনুকরণমূলক আত্মহত্যা)-এর প্রবণতা তৈরি হচ্ছে শহরে? সেই কারণেই কি সামনে আসছে পর পর একই রকম ভাবে মৃত্যুর ঘটনা?
লালবাজারের কর্তাদের দাবি, চিন্তায় রয়েছেন তাঁরাও। একই ধরনের ঘটনা লকডাউনের পরে উঠতি অভিনেতা, মডেলদের পর পর মৃত্যুর সময়েও দেখা গিয়েছিল বলে দাবি তাঁদের। যুগ্ম-নগরপাল পদমর্যাদার এক পুলিশকর্তা এ দিন বলেন, ‘‘সেই সময়ে কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। প্রতিবেশীদের সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে পৌঁছে এক জনকে বাঁচানোর পরে তিনি বলেছিলেন ‘‘ও তো কী সুন্দর পালিয়ে গেল। আমি পারলাম না!’’ একই রকম পরিস্থিতিতে অন্য কারও মৃত্যু তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ব্যাপারটি মারাত্মক।’’
মনোরোগ চিকিৎসকদের দাবি, কোনও নির্দিষ্ট কারণে চিন্তায় থাকা মানুষের উপরে একই রকম পরিস্থিতিতে কারও আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার ঘটনা প্রভাব ফেলে আরও বেশি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তখন ভাবতে শুরু করেন, আত্মহননই বোধহয় নিস্তার পাওয়ার সব চেয়ে ভাল উপায়। ওই সময়ে এমন এক মানসিক পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে নিজের সন্তানকেও আর বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে কাজ করে না। পরিবারের যে সদস্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বাকিদের তাতে রাজি করালেন, তিনি ধরে নেন, তাঁর মৃত্যুর পরে সন্তান ভুগবে আরও বেশি। মেরে ফেলার মাধ্যমে তাকে কার্যত মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করতে শুরু করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি।
মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘যে কোনও ব্যক্তি বা পরিবার বহু কারণে সমস্যার মধ্যে থাকতে পারেন। সেই সমস্যার মধ্যেও হয়তো কোনও পরিবার মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার মধ্যেই একই কারণে আত্মহত্যার ঘটনার খবর জানলে সমস্যা তৈরি হয়। তখন হয়তো অনেকে ভাবেন, তাঁদেরও এই রকম করা উচিত। আত্মহত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার বদলে এমন প্রচার করার বিরুদ্ধে সচেতন অবস্থান নেওয়া দরকার।’’ মনোরোগ চিকিৎসক দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বললেন, ‘‘কেউ আত্মহত্যা করেছেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন জানা গেলেই ধরে নেওয়া হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হয়তো অবসাদে ভুগছিলেন। কিন্তু আত্মহত্যার একাধিক কারণ থাকতে পারে। সেই কারণগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। শুধু অবসাদে ছিলেন, তাই আত্মহত্যা করেছেন, এমনটা ধরে নেওয়া ঠিক নয়। আত্মহত্যার খবরের প্রচার করা ছেড়ে আশপাশে এমন ব্যক্তি বা পরিবার রয়েছে কিনা, সে দিকে নজর রাখা দরকার। সব সময়ে সুরাহার পথ দেখাতে না পারলেও সমস্যা শুনতে এগিয়ে যাওয়া উচিত আমাদের।’’
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, কোনও ব্যক্তির ব্যবহারিক বদল এসেছে কিনা, অন্যদের থেকে নিজেদের কোনও পরিবার বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে কিনা, এ ব্যাপারে নজর দেওয়া প্রয়োজন। মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের দাবি, এর সঙ্গেই এ ব্যাপারে চাই সচেতনতামূলক সরকারি প্রচার। মৃত্যুর ঘটনার প্রচার ছেড়ে কোনও পরিবার কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াল, সেই ধরনের গল্প সামনে আনা এই মুহূর্তে আরও বেশি জরুরি।
দিনকয়েক আগেই ৭১ বছরের স্ত্রীকে নিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিউ টাউনের বাসিন্দা ৭৮ বছরের এক বৃদ্ধ। তাঁদের পুত্র কর্মসূত্রে বিদেশে থাকেন। সম্প্রতি সেখানেই পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়ে সেই পুত্র এখন শয্যাশায়ী। ঘটনার পর থেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করেন বয়স্ক দম্পতি। প্রাতর্ভ্রমণ, প্রবীণদের আড্ডাতেও যাওয়া বন্ধ করে দেন। এর পরে এক দিন অনেকগুলি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেন তাঁরা। কিন্তু বেঁচে ফিরে ওই দম্পতি জানাচ্ছেন, ছেলের ঠিক করে দেওয়া একটি সংস্থা থেকে তাঁদের খোঁজখবর নিতে লোক আসত। কিন্তু শয্যাশায়ী হওয়ার পরে টাকা দিতে না পারায় সেই সংস্থা লোক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ছেলের দায়িত্ব নেওয়ার বদলে নিজেরাই বোঝা হয়ে গিয়েছেন বলে তাঁদের মনে হতে শুরু করে। সেই থেকেই বেছে নেন চরম পথ। কিন্তু বৃদ্ধা বললেন, ‘‘ছেলেকে এখন কথা দিয়েছি, ঠিক থাকব। ছেলে চাকরি ছেড়ে ফিরে আসছে। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে হালকা হয়েছি। নিজেদের বুঝিয়েছি, কিছু না কিছু ব্যবস্থা হয়েই যাবে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)