Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Debanjan Deb

নকল নথি তৈরির গুণেই কি ‘সাম্রাজ্য’ দেবাঞ্জনের

অফিসারদের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই পুরসভার একাধিক নথিপত্র হাতে আসতে থাকে দেবাঞ্জনের।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২১ ০৮:২৪
Share: Save:

ছেলেবেলায় নাকি ভাল ছবি আঁকত সে। শৈশবের সেই গুণই কি প্রতিষেধক-কাণ্ডে জালিয়াতির ক্ষেত্রে দেবাঞ্জন দেবের অনেকটা সুবিধা করে দিয়েছিল? ভুয়ো প্রতিষেধক শিবিরের ঘটনায় তদন্ত যত এগোচ্ছে, দেবাঞ্জনের শৈল্পিক গুণাবলীর সঙ্গে তার জালিয়াতির কারবারের নিবিড় যোগাযোগও ততই সামনে আসছে। পুলিশের দাবি, এর সঙ্গেই যুক্ত হয়েছিল, কোনও কিছু এক বার দেখেই তা দীর্ঘ দিন মনে রাখতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা।

এত দিন ধরে ঠিক কী ভাবে দেবাঞ্জন তার প্রতারণার কারবার চালিয়ে গেল, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গিয়েছে, মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ারের ব্যবসা শুরু করার পরে ২০২০ সাল থেকে আরও বেশি করে পুরসভায় যাতায়াত শুরু করে দেবাঞ্জন। সেই সময়ে ব্যবসায় কিছু সুবিধা পাওয়ার আশায় একাধিক পুর প্রতিনিধির হয়ে বিনামূল্যে মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ার বিতরণ শুরু করে ওই যুবক। ধীরে ধীরে তার পরিচিতি বাড়ে পুরসভার একাধিক পদস্থ আধিকারিকের সঙ্গে। এর পরে হঠাৎই এক দিন পুর আধিকারিকদের দেবাঞ্জন জানায়, সে আইএএস পরীক্ষায় পাশ করেছে।

অফিসারদের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই পুরসভার একাধিক নথিপত্র হাতে আসতে থাকে দেবাঞ্জনের। সেই সমস্ত নথিতে কোন ফন্ট ও রং ব্যবহার করা হত এবং কী বয়ানে চিঠি লেখা হত, তা ভাল করে দেখা নিত দেবাঞ্জন। পরবর্তীকালে সেই সব নথির অনুকরণেই জাল সরকারি নথি তৈরি করতে শুরু করে সে।

এর পরেই নিজেকে পুর আধিকারিক হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করে ওই জালিয়াত। নিজের শৈল্পিক গুণকে কাজে লাগিয়ে পুরসভার নকল লেটারহেড এবং নোটিসের ‘ফরম্যাট’ তৈরি করে কম্পিউটারে। পুলিশের দাবি, সেই কাজ করতে গিয়ে এক বার মাঝপথেই থামতে হয় তাকে। কারণ, পুরসভার নথির সঙ্গে তার বানানো নথির ফন্টের আকার কিছুতেই মিলছিল না।

সূত্রের খবর, দেবাঞ্জনের অফিস থেকে পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের কয়েকটি ফাইল পাওয়া গিয়েছে। তদন্তকারীদের অনুমান, সমস্যায় পড়ে ওই সমস্ত ফাইল পুরসভা থেকে চুরি করেছিল সে। সেই সব ফাইলে থাকা নথিপত্রের অক্ষরের আকৃতি ও ধরন দেখে ফোটোশপে তা তৈরি করে নেয় দেবাঞ্জন। তার পরে তা ছাপায় শিয়ালদহের কয়েক জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। একই ভাবে ডালহৌসি থেকে সে তৈরি করিয়েছিল ভুয়ো রাবার স্ট্যাম্প। পুলিশের দাবি, এর পরবর্তী সময়ে পুরসভার কয়েক জন আধিকারিকের কাছ থেকেও সাহায্য পেয়েছে সে।

২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে চলতি মাস পর্যন্ত টেন্ডার ডেকে পুরসভার যে যে কাজ হয়েছে, তার বড় অংশই ছিল দেবাঞ্জনের নখদর্পণে। পুরসভার কন্ট্র্যাক্টরদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল দেবাঞ্জন। তত দিনে অবশ্য পুরসভার যুগ্ম কমিশনার হিসেবে একাধিক ভুয়ো নথি বানিয়ে ফেলেছে সে। কন্ট্র্যাক্টরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে তাঁদের বলে, তাকে সাব-কন্ট্র্যাক্টর করা হলে সে সহজেই পুরসভার কাজ পাইয়ে দেবে। এ ভাবেই বাড়তে থাকে দেবাঞ্জনের ‘সাম্রাজ্য’।

সূত্রের খবর, এর পরে প্রতিষেধক দেওয়া নিয়ে পুরসভার এক স্বাস্থ্য আধিকারিকের সঙ্গে মতবিরোধ হয় তার। যার জেরে খানিকটা মুশকিলে পড়ে যায় সে। দেবাঞ্জন বেশ কিছু প্রতিষেধক পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা জোগাড় করতে না-পেরে খোলা বাজার থেকে অন্য রোগের তরল ওষুধ কিনে সেটাই
প্রতিষেধক হিসেবে দেওয়ার পরিকল্পনা করে দেবাঞ্জন। গোয়েন্দা বিভাগের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘পুরসভার কারা কারা দেবাঞ্জনের উত্থানে তাকে সাহায্য করেছিলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। থানা স্তরে কারা তাকে সুবিধা করে দেন, তারও তদন্ত হবে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, কলকাতা পুরসভার শাখা অফিসের কায়দায় নিজের অফিস সাজাতেই ২০ লক্ষ টাকার উপরে খরচ করেছিল দেবাঞ্জন। তার অফিসে ব্যবহৃত ব্যানার, লিফলেট, লেটারহেড— সবই তৈরি হয়েছিল ফোটোশপে। তার কম্পিউটার থেকে এই সংক্রান্ত সমস্ত নথি উদ্ধার করা হয়েছে।’’ বিনা বাধার এই কর্মকাণ্ডে শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়াল প্রতিষেধকই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Debanjan Deb
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE