Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

সরকারি স্তরে ভ্রূণের ত্রুটি ধরার পরিকাঠামোই নেই

আজ, ২১ মার্চ ‘বিশ্ব ডাউন সিন্ড্রোম দিবসে’ তাই উঠে আসছে সেই প্রশ্ন, ভ্রূণের জটিলতা নির্ধারণে কেন পেরিয়ে যাচ্ছে ২০ সপ্তাহ?

জয়তী রাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৯ ০১:২৪
Share: Save:

মাস দু’য়েক আগের ঘটনা। ২৬ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা, চল্লিশোর্ধ্ব এক গৃহবধূ কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে আর্জি জানিয়েছিলেন, তাঁর গর্ভস্থ সন্তান ডাউন সিন্ড্রোম নিয়ে জন্মাবে। সে কারণে তাঁকে গর্ভপাতের অনুমতি দেওয়া হোক। ডাউন সিন্ড্রোম, হার্ট এবং পেটের বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে জন্মানো শিশুটির পরিচর্যা করতে গিয়ে আর্থিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে পরিবার, বুঝেছিলেন বিচারপতি। তাই ‘দি মেডিক্যাল টার্মিনেশন অব প্রেগন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৭১’ অনুযায়ী ২০ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত করানোর নিয়মের বাইরে বেরিয়ে গর্ভপাতের পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন তিনি।

জুলাই, ২০১৭। এ শহরের বাসিন্দা, ২৬ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা এক তরুণীকে দৃষ্টান্তমূলক রায়ের মাধ্যমে গর্ভপাতের অনুমতি দিয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আদালতের যুক্তি ছিল, ৩৩ বছরের ওই তরুণীর গর্ভস্থ ভ্রূণের জন্মগত অসুখ ধরা পড়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, শিশুটি জন্ম নিলেও তাকে একাধিক অস্ত্রোপচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তার পরেও সে বেশি দিন বাঁচবে না।

আজ, ২১ মার্চ ‘বিশ্ব ডাউন সিন্ড্রোম দিবসে’ তাই উঠে আসছে সেই প্রশ্ন, ভ্রূণের জটিলতা নির্ধারণে কেন পেরিয়ে যাচ্ছে ২০ সপ্তাহ?

শহরের চিকিৎসকেরা বলছেন, গর্ভস্থ শিশু থ্যালাসেমিয়া, ডাউন সিন্ড্রোম, হৃদ্‌যন্ত্রের জটিলতা, মস্তিষ্ক এবং সুষুম্নাকাণ্ডের কোনও ব্যতিক্রম নিয়ে জন্মাবে কি না, তা ভ্রূণ পরীক্ষায় জানতে পারা যায়। প্রথম তিন মাসে (১২ সপ্তাহে) ফিটাল আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান করলে এই ধরনের জটিলতা ধরা পড়ে। স্ক্যানে ‘হাই রিস্ক’ দেখা যাওয়ার অর্থ, শিশুটির ডাউন সিন্ড্রোম হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সেটা দেখার জন্য অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড নিয়ে পরীক্ষা হয়। কিন্তু সমস্যা হল, রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার স্ক্রিনিংয়ের (এফটিএস) ব্যবস্থাই নেই। বেসরকারি ক্ষেত্রে তা হাতে গোনা জায়গায় হয়। কিন্তু তারাও মুম্বই ও চেন্নাই থেকে এই পরীক্ষা করিয়ে আনে। যা যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ।

প্রসঙ্গত, এফটিএস-এর জন্য প্রয়োজন জেনেটিক ল্যাব, ফিটাল মেডিসিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাইনিকোলজিস্ট, নিওনেটোলজিস্ট, রেডিয়োলজিস্টকে নিয়ে গড়া বিশেষজ্ঞ-দল। চিকিৎসকেরা মানছেন, সরকারি হাসপাতালে এফটিএস পরীক্ষার পরিকাঠামো গড়ে না ওঠার অন্যতম কারণ ফিটাল মেডিসিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাইনিকোলজিস্টের অভাব।

অনেক চিকিৎসক এ-ও বলছেন, ডাক্তার ও রোগীদের একাংশের সেই স্তরে সচেতনতাই নেই। ‘‘সরকারি হাসপাতালে আসা রোগীরা বাইরে থেকে ডাউন সিন্ড্রোমের পরীক্ষা করাতে পারেন না। কারণ, তা খরচ সাপেক্ষ। তাঁদের সেই আর্থিক সামর্থ্য নেই। অথচ ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্তের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে।’’— বলছেন এসএসকেএম হাসপাতালের এক স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক। শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, ‘‘হৃদ্‌যন্ত্রের জটিলতা বা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তের মতো জীবনের ঝুঁকি না থাকলেও যারা ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত, তাদের তো বটেই, পরিবারকেও কঠিন আর্থিক ও মানসিক লড়াই করতে হয়। ওদের জন্য একাধিক অস্ত্রোপচার এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যা যথেষ্ট ব্যয়বহুল।”

অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গাইনিকোলজির অধ্যাপক, চিকিৎসক কুশাগ্রধী ঘোষ জানান, গত কয়েক বছরে বিশ্ব জুড়ে ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যা রীতিমতো চিন্তার। ভারতে প্রতি আটশোয় এক জন শিশু জন্মাচ্ছে এমন উপসর্গ নিয়ে। কুশাগ্রধীবাবুর মতে, ‘‘থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষার মতোই ডাউন সিন্ড্রোম পরীক্ষা নিয়ে সরকারি স্তরে ভাবার সময় এসেছে। গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসেই জানতে পারা যায় ঝুঁকির মাত্রা। হাই রিস্ক হলে অ্যামিনিয়োসেন্টেসিস করে নেওয়া জরুরি।”

সরকারি চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, ভ্রূণের অন্য জটিলতা আছে কি না, তা নির্ধারণে সরকারি হাসপাতালে অবিলম্বে ফিটাল স্ক্যান শুরু করা উচিত। তা হলেই ২০ সপ্তাহ পার করে গর্ভপাত করানোর মতো পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।

রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলছেন, ‘‘ফিটাল মেডিসিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাইনিকোলজিস্টের অভাবই মূল সমস্যা। তবে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালের নিজস্ব ল্যাবে শুরু করার কথা ভাবা হচ্ছে। ওই পরিষেবা চালু হলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন। সেই সঙ্গে পিজি পলিক্লিনিকের বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স সেন্টারটিকে আরও উন্নত করা হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

World Down Syndrome Day Health Disease Fetus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE