E-Paper

মজুরি-বিমায় বঞ্চনা, বিপদ মাথায় উৎসবের শহর সাজাচ্ছেন ওঁরা

পুজোর আগে এই মুহূর্তে শহরের সৌন্দর্যবৃদ্ধির কাজ চলছে। নানা জায়গায় ফুটপাতের ধারের রেলিং, পথবিভাজিকা, বাতিস্তম্ভে নতুন রঙের প্রলেপ পড়ছে।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৫:৩৬
কোনও রকম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে উল্টোডাঙার কাছে পছবিভাজিকার রেলিং রং করার কাজ।

কোনও রকম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে উল্টোডাঙার কাছে পছবিভাজিকার রেলিং রং করার কাজ। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

প্রতিবাদ আন্দোলন আর পুজোর কেনাকাটার ভিড়ে দীর্ঘক্ষণ যানজটে আটকে থাকার পরে রাস্তা সামান্য ফাঁকা পেয়েছিলেন এক গাড়িচালক। কোনও মতে গতি বাড়িয়ে বেরোতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের এক দিকে কেউ যে অন্ধকারে হাঁটু মুড়ে বসে পথবিভাজিকার রেলিং রং করার কাজ করছেন, বুঝেই উঠতে পারেননি তিনি। সজোরে সেই গাড়ি ধাক্কা মারে রঙের বালতিতে। তবে বরাত জোরে রক্ষা পান সেই ব্যক্তি। পুলিশ গাড়িচালককে দাঁড় করালে তিনি বলেন, ‘‘সন্ধ্যায় অন্ধকারে কেউ যে রাস্তায় বসে রং করার কাজ করবেন, ভাবতেই তো পারিনি। হেডলাইট সে দিকে পড়তেই দেখতে পেয়ে কোনও মতে বাঁচিয়েছি!’’

কিন্তু চোখে না পড়লে? কোনও মতে রক্ষা পাওয়া সেই ব্যক্তির বক্তব্য, বড় বিপদ ঘটে যেতে পারত।

পুজোর আগে এই মুহূর্তে শহরের সৌন্দর্যবৃদ্ধির কাজ চলছে। নানা জায়গায় ফুটপাতের ধারের রেলিং, পথবিভাজিকা, বাতিস্তম্ভে নতুন রঙের প্রলেপ পড়ছে। বহু জায়গায় এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার সংস্কার করতে পিচ ঢালাইয়ের কাজ চলছে। অভিযোগ, এর বেশির ভাগ কাজই চলছে রাত পর্যন্ত, কোনও রকম নিরাপত্তার বন্দোবস্ত ছাড়াই। এই কাজে যুক্তদের মুখে মাস্ক বা মাথায় হেলমেট পরে থাকার নিয়মও প্রায় কোথাওই মানা হচ্ছে না। নিরাপত্তার জন্য অবশ্য ব্যবহার্য সরঞ্জাম রাখা তো দূর, অন্ধকারে দেখতে পাওয়ার সুবিধার জন্য সামান্য চকচকে পোশাক বা জ্যাকেট পরেও বহু জায়গাতেই কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ। যেখানে কাজ হচ্ছে, সেই জায়গা পুলিশের তরফে ঘিরে রাখার কথা থাকলেও আদতে তা-ও করা হচ্ছে না। এই অবস্থায় বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বহু ক্ষেত্রেই। কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, গত এক সপ্তাহে রাস্তায় কাজ করতে গিয়ে গাড়ি বা মোটরবাইকের ধাক্কায় আহত হওয়ার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। তিনটি ক্ষেত্রে আহতেরা এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এই সূত্রে উঠে আসছে বছর দুয়েক আগের এ জে সি বসু উড়ালপুলে গাড়ির ধাক্কায় এক সাফাইকর্মীর মৃত্যুর ঘটনা। পূর্ণিমা দেবী নামে বছর পঁয়তাল্লিশের ওই মহিলা হাওড়ার জগৎ ব্যানার্জি ঘাট রোডের এক বস্তির বাসিন্দা। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ তিনি এবং আরও কয়েক জন এ জে সি বসু উড়ালপুলে ঝাঁট দেওয়ার কাজ করছিলেন। রবীন্দ্র সরোবরের দিক থেকে একটি গাড়ি দ্রুত গতিতে উঠে এসে ওই মহিলাকে ধাক্কা মেরে কিছুটা হিঁচড়ে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ওই ঘটনাতেও যে হুঁশ ফেরেনি, তা এই মুহূর্তে শহরের রাস্তায় ঘুরলেই বোঝা যাচ্ছে। ওই মহিলার সঙ্গেও সেই দিন কোনও নিরাপত্তা-সরঞ্জাম ছিল না বলে অভিযোগ। দ্রুত গতিতে গাড়ি চলে যে রাস্তায়, সেখানে এ ভাবে কাজ করানো হয়েছিল কার সিদ্ধান্ত মেনে, সেই প্রশ্নেরও উত্তর মেলেনি। এ নিয়ে পূর্ণিমার মেয়ে কিরণ বৃহস্পতিবার ফোনে বলেন, ‘‘কিছুই বদলায়নি। এখনও ওই ভাবেই কাজ করানো হয়। আমাদের বস্তিরই অনেকে এই কাজ করেন। আমরা তো কোনও ক্ষতিপূরণও পাইনি।’’

শ্রমিক-স্বার্থে কাজ করা সংগঠন ‘নাগরিক মঞ্চ’-এর সাধারণ সম্পাদক নব দত্তের আবার অভিযোগ, ‘‘রাতদিন কাজ করিয়ে শহর সাজানোর চেষ্টা চলছে পুজোর আগে। কিন্তু যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করার কেউ নেই। এই ধরনের কাজে যুক্তদের মজুরি দৈনিক ন্যূনতম ৩৫৫ টাকা হওয়ার কথা এই রাজ্যে। কিন্তু বেশির ভাগই ১০০ টাকা বা দেড়শো টাকা দৈনিক মজুরিতে তাঁরা কাজ করছেন।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘কিছু ঘটে গেলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্ব ঠিকাদার সংস্থার, যারা এঁদের নিয়োগ করেছে এবং পুরসভার মতো মূল সংস্থার, যারা কাজ করাচ্ছে। কিন্তু দু’পক্ষই টালবাহানা করে থাকে। সরকারের কল্যাণমূলক তহবিল থেকেই এঁরা ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। কিন্তু ঠিকাদার সংস্থা এঁদের নাম শ্রমিক হিসাবে নথিভুক্ত করায় না। এই কাজে যুক্তদেরও সচেতনতা নেই। ভাবে না সরকারও। ফলে চলতেই থাকে বঞ্চনা। পুজো আসে পুজো যায়, শ্রমদানকারীদের অবস্থা বদলায় না।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Durga Puja 2024

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy