Advertisement
E-Paper

মেধায় ভর করেই বাধা পার

চিৎপুরের প্রাণকৃষ্ণ মুখার্জি রোডের খাল লাগোয়া ওই ঝুপ়ড়িতে সকাল থেকেই প্রবল ব্যস্ততা। পাড়ার মেয়ে মাধবী প্রামাণিকের রেজাল্ট বেরোবে।

নীলোৎপল বিশ্বাস ও সৌরভ দত্ত

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৮ ০৩:০৮
উচ্চ মাধ্যমিকের ফল হাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে মাধবী প্রামাণিক। চিৎপুরের বাড়িতে।

উচ্চ মাধ্যমিকের ফল হাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে মাধবী প্রামাণিক। চিৎপুরের বাড়িতে।

খাল লাগোয়া মাটির উনুনের সামনেই ঘুরঘুর করছে এক পাল শুয়োর। তাদের খেদাতে উনুনে গোঁজা চেলাকাঠ হাতে তে়ড়ে গেলেন এক মহিলা। ফিরেও এলেন দ্রুত। চোখে-মুখে ব্যস্ততার ছাপ স্পষ্ট। উনুনে কাঠ গুঁজে দিয়ে আঁচ বাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘‘মেয়ে এখুনি চলে আসবে। পায়েসটাই এখনও হল না! এই পায়েসের জন্যই ওর সঙ্গে যেতে পারলাম না!’’

চিৎপুরের প্রাণকৃষ্ণ মুখার্জি রোডের খাল লাগোয়া ওই ঝুপ়ড়িতে সকাল থেকেই প্রবল ব্যস্ততা। পাড়ার মেয়ে মাধবী প্রামাণিকের রেজাল্ট বেরোবে। বেলা বাড়তে এই ব্যস্ততাই বদলে যায় প্রবল উচ্ছ্বাসে। ঝুপড়িতে খবর যায়, শত বাধা পার করে উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করেছেন মাধবী।

বাধাই বটে। গত জানুয়ারিতে আগুন লাগে মাধবীদের ঝুপড়ির ঘরে। বই-খাতা, নোটস— সর্বস্ব পুড়ে যায় মাধবীদের। পুড়ে যায় টেস্ট পেপারটাও। সেই অবস্থার মধ্যে থেকেই সর্বশিক্ষা মিশন কলকাতা এবং এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে উচ্চ মাধ্যমিক দেন মাধবী। এ দিন ফল প্রকাশের পরে মাধবীর সঙ্গে স্কুলে গিয়ে রেজাল্ট আনতে চেয়েছিলেন মাধবীর মা অঞ্জলি। তবে মেয়ে পায়েস খেতে চাওয়ায় যাওয়া হয়নি। অঞ্জলি বললেন, ‘‘মেয়েটা পরীক্ষা দিতে পারবে ভাবিনি। আমাদের ঘরই তো পুড়ে গিয়েছিল। আজ স্কুল থেকে মেয়ের সঙ্গে যেতে বলেছিল, কিন্তু যাওয়া হল না।’’

একই অবস্থা এ বারের উচ্চ মাধ্যমিকে মেধা তালিকায় অষ্টম স্থানাধিকারী বিশ্বজিৎ দত্তের বাবা শিবনারায়ণের। দমদম পার্কের কৃষ্ণপুর আদর্শ বিদ্যামন্দিরের ছাত্র বিশ্বজিৎ মেধা তালিকায় অষ্টম স্থানাধিকারী। পাশাপাশি বাণিজ্যে সারা রাজ্যে প্রথম হয়েছেন তিনি। তাঁর মোট প্রাপ্ত নম্বর ৪৮৩। শিবনারায়ণবাবুর ইচ্ছে ছিল মার্কশিট যখন স্কুলে দেওয়া হবে তখন একমাত্র ছেলের পাশে থাকবেন। কিন্তু রুজির টানে সেই মুহূর্ত উপভোগ করতে পারেননি তিনি।

বাবা-মায়ের সঙ্গে বিশ্বজিৎ দত্ত। শুক্রবার, বাগুইআটিতে।

ছয় ভাইয়ের সংসারে খোলা বাজার থেকে মুড়ি কিনে তা বাড়িতে বিভিন্ন ওজনের প্যাকেটে ভরে বিক্রি করেন শিবনারায়ণবাবুরা। এই কাজে তাঁকে সাহায্য করেন স্ত্রী। শুক্রবার শিবনারায়ণ বলেন, “মুড়ি ওজন করে প্যাকেটে ভরার কাজ খুব সময়সাপেক্ষ। ছেলেও মাঝেমধ্যে আমাদের সাহায্য করে।” এ দিন যখন স্ত্রী এবং ছেলের সঙ্গে স্কুলে যাবেন বলে বেরোচ্ছেন তখন‌ই মুড়ির গাড়ি চলে আসে। শিবনারায়ণের কথায়, “স্ত্রীকে বললাম ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাও। আমি আসছি। কিন্তু আর হল না।’’ তবে টেলিভিশনে যতটা সময় পেয়েছেন ছেলেকে দেখেছেন। কৃতী ছাত্রের বাবা হিসেবে গর্বের মুহূর্তে মাঝেমধ্যেই চোখ ছলছল করে উঠছে। বিশ্বজিতের মা মঞ্জু দত্ত বললেন, ‘‘যত কষ্ট‌ই হোক ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারে ওর বাবা না করেনি। আসল মুহূর্তে থাকতে পারল না, খুব খারাপ লাগছে।’’ বিশ্বজিতের স্কুলের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, “বিশ্বজিৎ ছোট থেকেই ভাল ছাত্র। জীবনে আরও বড় হোক।’’

মাধবীর বাবা নীলাম্বর গাড়ি চালাতেন। তবে শারীরিক কারণে এখন আর কাজ করতে পারেন না। তিনি চান, মেয়ে বড় হয়ে স্কুলে পড়াক। বললেন, ‘‘আমরা ঝুপড়িতে থাকি। যখন আগুন লাগল মেয়ের স্বপ্নটাই পুড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে নিজের চেষ্টায় ও পাশ করেছে। আমরাও এখন মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি, চাই ও স্কুলে পড়াক।’’ মাধবী ইতিহাস নিয়ে পড়তে চান। স্কুলে পড়ানোর স্বপ্নও দেখেন। আর বাগুইআটির শচীন্দ্রলাল সরণির গৌতম পাড়ার বাসিন্দা বিশ্বজিৎ জানান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে চান তিনি। আর্থিক অনটনের সংসারে ছেলের সেই লক্ষ্যপূরণের স্বপ্ন দেখছেন দত্ত পরিবারের সদস্যেরাও।

ছবি: শৌভিক দে, স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

HS result 2018 HS উচ্চমাধ্যমিক Higher Secondery
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy