নিজের ট্যাক্সি নিয়ে অমরনাথবাবু। নিজস্ব চিত্র
আমাদের পেশার বদনাম হয়ে গিয়েছে। ২৪ বছর ধরে হলুদ ট্যাক্সি চালাচ্ছি। এখন বুঝি এ বদনাম আর ঘোচার নয়। তবে সবটাই যে বদনাম নয়, এটা মানি। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তবে সব সময়ে অকারণে ‘যাব না’ বলি, এ কথা মানতে পারব না। সরকার বা আমাদের সংগঠন— সমস্যার কথা কেউই শোনে না। ফলে সেগুলির সমাধানও হয় না। বাড়তি রোজগারের জন্য তখন বুঝেশুনে যাত্রী তুলতে হয়। বাড়তি ভাড়া চাইতে হয়।
আমার বাড়ি ব্যারাকপুরে। প্রতি দিন সকাল আটটা নাগাদ ট্যাক্সি নিয়ে বেরোই। দুপুরে আধ ঘণ্টার খাওয়া ছাড়া রাত ৮টা পর্যন্ত একটানা গাড়ি চালাই। সাড়ে ৮টা নাগাদ বিটি রোডের দিকের যাত্রী তুলে ফিরি। এটাই অভ্যাস। এত দিনে কাউকে ফেরাইনি এমন নয়। আচ্ছা বলুন তো, রাত আটটায় কেউ যদি বলেন গড়িয়াহাট যাবেন, আমি তাঁকে কেন তুলব? তুলি না। আমি তো যন্ত্র নই। সারা দিনের পর ফেরার পথে বাড়ির দিকেরই যাত্রী তুলব। এটুকু ঠিক করার অধিকার আমার থাকবে না? অনেকেই বলবেন, পছন্দের রুটের যাত্রী নেওয়া নিয়ম নয়। সে তাঁরা যা বলার বলুন! দিনের শেষে নিজের সুবিধাটাই দেখব। ব্যস্!
তা ছাড়া গত সরকারের সময়েও দেখেছি, আমাদের জন্য কারও ভাবনা নেই। ভোটের সময়ে একটু কদর বাড়ে। ফের যে কে সেই। ডিজেলের দাম দু’দিন অন্তর বাড়ছে। পুলিশ যখন-তখন ধরে জরিমানা করছে। ট্যাক্স বেড়ে যাচ্ছে প্রতি বছর। কিন্তু আমাদের শেষ ভাড়া কবে বেড়েছে, ভাবুন! এগুলো কোনও যাত্রীরা দেখেন?
তবে দিনের বেলা যাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা এখন কমেছে। গাড়ির গায়ে অভিযোগ জানানোর ১০৭৩ ‘টোল ফ্রি’ নম্বর লেখা থাকে। সেই ভয়ে অনেকেই ঝুঁকি নিই না। তা ছাড়া অনেক যাত্রীই নিজেদের চেনা নম্বরে ফোন করে পুলিশ ডেকে নেন।
হ্যাঁ, মানছি অনেক চালকই এর মধ্যে নিজেদের ইচ্ছেমতো যাত্রীদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন। বাড়তি লাভের জন্য দিনভরই তাঁরা সুবিধামতো যাত্রী তোলেন। যে পথ মিটারে গেলে ৬০ টাকা উঠবে, সেই পথের যাত্রী নেওয়ার বদলে দূরের যাত্রী নিতে পছন্দ করেন। ওঁদের মনে হয়, কম দূরত্বে গেলে লাভ কম হবে। আবার অনেকেই কম পথ যেতে শর্ত দেন, বিনা মিটারে যেতে হবে। যেখানে ৬০ টাকা উঠবে, সেখানে হাঁকেন ১৫০ টাকা। এটা ঠিক নয়, জানি। কিন্তু কী করে দোষ দেব বলুন তো? এই বাড়তি টাকাটুকুই আমাদের ভরসা।
আমার নিজের ট্যাক্সি। দিনে ১০০০-১২০০ টাকা আয়। তার থেকেই তেল, ট্যাক্স, গাড়ির দেখভাল। যাঁরা ভাড়ায় চালান, তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ। দিনে ৪০০-৫০০ টাকার বেশি হয় না। মাঝেমধ্যে আমিও বাড়তি ২০-৩০ টাকা চাই। কারণ অনেক সময়ে এমন দিকে যেতে হয়, যেখান থেকে ফাঁকা ফিরতে হয়। এক বার পুজোর সময়ে পুলিশ নিয়ে এসে এক মহিলা উঠেছিলেন। তখন প্রবল খিদে পেয়েছে। তবু তর্ক বাড়াইনি। কারণ সে দিন বিশেষ আয় হয়নি। কিন্তু খুব রাগ হয়েছিল। ভেবেছিলাম সুযোগ পেলে আরও বেশি টাকা চাইব। তবে রাগটা বেশি ক্ষণ থাকেনি।
২০১৬ সালে আমার বউ, ভারতী মারা গিয়েছেন। কিডনির সমস্যা ছিল। সে ভাবে চিকিৎসা করাতে পারিনি। আমাদের মতো ট্যাক্সিওয়ালাদের জীবন এমনই। ২০-৩০ টাকা বেশি নিয়ে সেটা বদলাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy