Advertisement
E-Paper

ট্র্যাফিক কিয়স্কে ‘বাবার’ সঙ্গে আহ্লাদ আব্দুলের

সেই শুরু। এক দিকে পথশিশু-জীবনের হাঁ হয়ে থাকা সমস্ত অনটন আর ক্ষত, উল্টো দিকে স্নেহ, মায়া, ভালবাসা, যত্ন। দুইয়ের লড়াইয়ে প্রথমের ভার সব সময়েই বেশি ছিল। বারবারই ফস্কেছে লাগাম। কিন্তু বছর দেড়েকের চেষ্টায় খেলা ঘুরেছে।

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৭ ১২:১৫
স্নেহ: মোহনলালবাবুর সঙ্গে আব্দুল। নিজস্ব চিত্র

স্নেহ: মোহনলালবাবুর সঙ্গে আব্দুল। নিজস্ব চিত্র

ধর্মতলার নেতাজি মূর্তির কাছে, ট্র্যাফিক কিয়স্কের বাইরে ঘোরাঘুরি করত ছেলেটা। ধুম রোদ বা ঝুম বৃষ্টি, তার টহলদারির অন্যথা হতো না। বছর এগারোর ছেলেটাকে এক দিন ডেকে কথা বলেন সাউথ গার্ডের ট্র্যাফিক কনস্টেবল মোহনলাল রায়। জানতে পারেন নিউ মার্কেট চত্বরে নানির সঙ্গে পথেই বাস আব্দুলের। মা-বাবা ছেড়ে চলে গিয়েছেন দিল্লি। মোহনলাল বোঝেন, শরীরের বয়সের তুলনায় আব্দুলের মনের বয়স অনেকটাই কম। তার উপরে, স্থানীয় ‘দাদা’দের শিক্ষায়, বিড়ি-ডেনড্রাইট-গালাগাল-ছিনতাইয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে আব্দুলের অবোধ শৈশব।

সেই শুরু। এক দিকে পথশিশু-জীবনের হাঁ হয়ে থাকা সমস্ত অনটন আর ক্ষত, উল্টো দিকে স্নেহ, মায়া, ভালবাসা, যত্ন। দুইয়ের লড়াইয়ে প্রথমের ভার সব সময়েই বেশি ছিল। বারবারই ফস্কেছে লাগাম। কিন্তু বছর দেড়েকের চেষ্টায় খেলা ঘুরেছে। মোহনলাল হয়ে উঠেছেন আব্দুলের ‘বাবা’। এই বাবা শুধু ডাকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সঙ্গে জুড়ে রয়েছে পর্যাপ্ত দায়িত্ববোধ ও পিতৃস্নেহ। সহকর্মীদের কাছেও তাঁর পরিচয়, আব্দুলের ‘মোহনবাবা’। ধর্মতলার ওই কিয়স্কে প্রায়ই দেখা যায়, মোহনলালের শাসনে-আদরে খিলখিল করে শৈশবের স্বাদ নিচ্ছে আব্দুল।

‘‘রোদে-জলে ধুলো মেখে খেলে বেড়াত ছেলেটা। দেখে বড় মায়া লাগে। দু’-একটা কথা বলেই বুঝতে পারি, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। বুড়ি ঠাকুরমার পক্ষে সম্ভব নয়, চোখে চোখে রাখা। আমি আলাদা করে কিছু করিনি, কেবল একটু কাছে ডাকতাম, যত্ন করতাম।’’ হেসে বলেন মোহনলাল। আর তাতেই স্নেহের পরত পড়ে ক্ষয়ে যাওয়া শৈশবে।

আরও খবর
ঘুম ভাঙল যখন, মাথাটা ভালুকের মুখের ভিতর!

ওই ট্র্যাফিক গার্ডেরই সার্জেন্ট ওয়াসিম বারি বলছিলেন, খুব কাছ থেকে দেখা এই বাবা-ছেলের সম্পর্কের কথা। তিনি বলেন, ‘‘রোজ দুপুরে কিয়স্কে বসে, নিজের টিফিনবাক্সের রুটি-তরকারি আব্দুলের সঙ্গে ভাগ করে নেন মোহন। আইপিএল-এ ডিউটি থাকলে নিজের খাবারের প্যাকেটের পাশাপাশিই আসে আব্দুল আর তার নানির খাবারও।’’ এখন অবশ্য মোহনবাবার ছেলে আব্দুলকে সকলেই চিনে গিয়েছেন। আদর বেড়েছে, বেড়েছে নজরদারি। আর সেই পথেই ফিরেছে শৈশব। এখন নিয়মিত স্কুলে যায় আবদুল। যদিও একমুখ হাসির সঙ্গে সে নিজেই স্বীকার করে নিল যে, পড়াশোনার চেয়ে মিড-ডে-মিলের আকর্ষণ অনেকটাই বেশি। আদুর গায়ে আর ঘুরতে দেখা যায় না তাকে। চটি জোড়া অবশ্য মাঝেমাঝেই হারিয়ে যায়। কোথাও কারও কাছ থেকে দু’-পাঁচ টাকা পেলেই ছুট্টে এসে ‘বাবা’কে দেওয়া চাই তার। সেখান থেকেই হিসেব করে খাওয়া হয় ফুচকা, ঝালমুড়ি, শরবত। কখনও বা জুটে যায় আব্দুলের অপ্রত্যাশিত ও পরিণত মন্তব্য, ‘‘বাবা, তোমার টাকা লাগলে আমার থেকে নিও।’’

কী করে ‘বাবা’ হয়ে উঠলেন মোহন? উত্তর দেবে কি, হেসেই অস্থির হয় ছোট্ট আব্দুল। হাসি আর দু’-একটা টুকরো অসংলগ্ন কথায় স্পষ্ট হয়, সকলের কাছে শুধু দুচ্ছাই পেতেই অভ্যস্ত ছিল সে। মোহনের কাছেই সে প্রথম বুঝতে পারে, তার আবদার শোনারও কেউ আছেন। তার জন্যও কেউ ভাবেন!

মোহনলাল আদতে জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। পঁচিশ বছর ধরে কর্মসূত্রে কলকাতায় বাস। মোহনের দুই মেয়ে ছন্দা আর কৃষ্ণাও এখন দিব্যি চিনেছেন আব্দুলকে। নতুন ‘ভাই’ পেয়ে দিব্যি মজা পেয়েছেন তাঁরা। আর মোহনের কাছে এসে আব্দুলের মাঝেমধ্যেই আবদার, ‘‘দিদিদের একটু ফোন করো তো, কথা বলব!’’ এ অস্থির সময়ে এমন স্নেহের সম্পর্ক দেখে অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন মোহনলালবাবুকে। আব্দুলের মোহনবাবার অবশ্য সরল কথা, ‘‘ওকে দেখে মায়া হয়েছিল। মায়ার তো কোনও ধর্ম হয় না। শৈশবের কোনও জাত হয় না। আমি খুব খুশি এই হঠাৎ পিতৃত্বে।’’

সাউথ গার্ডের এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘কঠিন দুনিয়া দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলি আমরা। ‘পুলিশ’ শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই যেন ভেসে ওঠে অপরাধ জগতের কালো ছবি। কিন্তু খাকি পোশাকের ভিতরে পুলিশেরও যে কিছু মানবিক গুণ আছে, তার প্রমাণ দেন মোহনের মতো কিছু কর্মী। তিনি আমাদের গর্ব।’’

Traffic Boy Care ট্র্যাফিক কিয়স্ক মোহনলাল রায় Traffic Constable
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy