Advertisement
০৪ মে ২০২৪
India Tour

ধুলো-পড়া অতীতের খোঁজে ধুলো উড়িয়ে ছুটছে গাড়ি

৫০ দিনে ১৬টি রাজ্য আর ১২ হাজার কিলোমিটারের হাতছানিতে বন্দর-নগরী কোচি থেকে স্টিয়ারিংয়ে বসে মিত্রা গাড়ি ছেড়েছেন গত ১৮ মার্চ।

পর্যটক: শহরে ছেলে নারায়ণনের সঙ্গে মিত্রা।

পর্যটক: শহরে ছেলে নারায়ণনের সঙ্গে মিত্রা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

সম্রাট মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২২ ০৬:৫০
Share: Save:

সেই ১৯২২ সলে রবার্ট ফ্রস্ট লিখেছিলেন— ‘দ্য উডস আর লাভলি, ডার্ক অ্যান্ড ডিপ, বাট আই হ্যাভ প্রমিসেস টু কিপ, অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ…’। ঠিক একশো বছর বাদে, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই প্রতিদিন ভোরে উঠে কেরল-নিবাসী মিত্রা সতীশকে হিসেব কষতে হচ্ছে, আজ যেন কত মাইল যেতে হবে?

৫০ দিনে ১৬টি রাজ্য আর ১২ হাজার কিলোমিটারের হাতছানিতে বন্দর-নগরী কোচি থেকে স্টিয়ারিংয়ে বসে মিত্রা গাড়ি ছেড়েছেন গত ১৮ মার্চ। সঙ্গী শুধু ১১ বছরের ছেলে নারায়ণন। বছরখানেক আগেও এক বার বেরিয়েছিলেন, গাড়ি চালিয়ে গোটা দেশ ঘুরতে। কিন্তু কোভিডের হানায় সেই সফর কাটছাঁট করে ফিরে আসতে হয়। মিত্রার এই সফরে নানা ভাবে সাহায্য করছে কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রক।

এ বারে তাঁর যাত্রার উদ্দেশ্য ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখা। ‘‘বড় বড় নামেদের কথা তো সকলেই জানেন। কিন্তু সাধারণ, একেবারে আটপৌরে বহু মানুষও কিন্তু স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিজেদের মতো করে শামিল হয়েছিলেন। অনেকের কথাই আমরা জানি না। জানলেও হয়তো ভুলতে বসেছি। তাই স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে বেরিয়ে পড়লাম। অনামা, অখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথাও একটু জানার চেষ্টা করছি।’’ শনিবার চৈত্রের তাপক্লান্ত দুপুরে কলেজ স্ট্রিটের শতাব্দীপ্রাচীন শরবত-বিপণিতে বসে গলা ভেজানোর ফাঁকে বলছিলেন কোচির সরকারি আয়ুর্বেদিক কলেজের অধ্যাপিকা মিত্রা।

একটু থেমে যোগ করলেন, ‘‘স্বাধীনতার যুদ্ধে সব ধর্মের মানুষই কিন্তু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে। সেখানে ধর্মের নামে বিভাজন ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজকাল সেই বিভাজনটাই চারপাশের পরিবেশকে বিষিয়ে দিচ্ছে। ইতিহাসের পাতায় ফিরে যাওয়াটা সেই কারণেও খুব দরকার।’’

পাশে বসে পা দোলাতে দোলাতে লালচে শরবতে স্ট্র ডুবিয়ে সুখটান দেওয়া ছেলেকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘নারায়ণনের পাঠ্যবইয়ে ধরাবাঁধা কিছু গল্প আছে। তাই বেরোনোর আগে ওকে স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক গল্প শুনিয়েছি, সিনেমা দেখিয়েছি। যাতে আগ্রহটা তৈরি হয়। ও কিন্তু খুব উপভোগ করছে।’’ স্বামী সতীশ বেড়াতে ভালবাসলেও এত দীর্ঘ সফরে আসার সময় পাননি। ১৬ বছরের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মেয়েকে রেখে এসেছেন তার দিদিমার কাছে। এ বছরই বোর্ডের পরীক্ষা তার।

যাত্রার নাম দিয়েছেন ‘ওরু আজ়াদি ড্রাইভ’। মালয়ালমে ‘ওরু’র অর্থ একটি। কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, ওড়িশা হয়ে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। মাতঙ্গিনী হাজরার টানে প্রথমে তমলুক। তার পরে কলকাতা। এ শহরে নেতাজি ভবন, শহিদ মিনার, মহাকরণ, হায়দরি মঞ্জিল, অ্যালবার্ট হল, বসুবাটী, ভারতসভা ভবন, টাউন হল, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কফি হাউস, প্যারামাউন্ট— তালিকাটা ছিল দীর্ঘ। সেই সঙ্গে গিয়েছিলেন সোনাগাছির যৌনপল্লিতেও। ওই যৌনপল্লি নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখতে চান মিত্রা।

এ শহর এবং তার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের গন্ধে ঘোর লেগে গিয়েছে তাঁর। মিত্রার কথায়, ‘‘পুরনো বাড়িগুলোর মধ্যে ঢুকে মনে হচ্ছিল, যেন ওই সময়ে ফিরে গিয়েছি। গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা। এ কোনও দিন ভোলার নয়।’’ কলকাতার মিষ্টি আর ইতিহাসে মুগ্ধ হলেও বর্তমান তাঁকে পীড়া দিয়েছে। ‘‘কলকাতায় এত দারিদ্র দেখব, ভাবিনি। এখনও মানুষকে হাতে রিকশা টানতে হয়, আর তাতে মানুষই চড়ে! এটা অবিশ্বাস্য! স্কুলের বাচ্চারা হাতে টানা রিকশায় চেপে যাচ্ছে, আর সেই রিকশা টানছেন তাদেরই দাদুর বয়সি কেউ। দেখে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।’’

এর পরেও তো অনেকগুলো রাজ্য বাকি। গোটা উত্তর ভারত ঘুরবেন। এ দেশে মহিলাদের সুরক্ষা যা হাল, আপনার ভয় করে না? এক মুহূর্তও না ভেবে তাঁর জবাব, ‘‘আরে না না, ভয় কিসের? আগেও তো বেরিয়েছি। মহিলা বলে আলাদা কোনও সমস্যায় কখনও পড়িনি।’’

রবিবার ভোরে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন কলকাতা থেকে। চুঁচুড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ি, ব্যারাকপুরের গান্ধী সংগ্রহশালা, পলাশির প্রান্তর হয়ে গন্তব্য কোচবিহার। সেখান থেকে অসম। তার পরে উত্তর ও মধ্য ভারত।

এখনও অনেকটা পথ বাকি। অধরা অনেক অভিজ্ঞতাও। বিভাজন-দীর্ণ এক দেশে স্বাধীনতা ও একতার ধুলো-পড়া অতীত সন্ধানে ধুলো উড়িয়েই ছুটছে গাড়ির চাকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India Tour tourism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE