ছবি সংগৃহীত।
কখনও শোনা যায়, ‘‘বাজারে বেগুন এসেছে!’’ কখনও আবার শোনা যায়, ‘মেন্ডক’ (ব্যাঙ) এসেছে। কিন্তু, এ বাজার কোনও আনাজের বাজার নয়। এই বেগুন আনাজও নয়। কেউ যদি আবার ভাবেন, সর্বভুক কোনও দেশের কাহিনি বর্ণনা করা হচ্ছে, তা হলেও ভুল করবেন। এ সবই আসলে চোরাই বাজারে গাড়ির ছদ্মনাম। তুলে নিয়ে আসার পরে এই নামেই হাতবদল হয় সেই সব গাড়ি। মালিক যতক্ষণে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাবেন এবং পুলিশ পদক্ষেপ করবে, তত ক্ষণে চুরি যাওয়া গাড়ি হয়তো টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। কাটাই হয়ে বেরিয়ে যাওয়া চোরাই গাড়ির যন্ত্রাংশ চলে গিয়েছে ভিন্ রাজ্যে বা দেশের বাইরে!
মাস দুয়েক আগে মধ্য কলকাতার জ়াকারিয়া স্ট্রিটে ট্যাক্সি চুরি আটকাতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল মহম্মদ ফিরোজ নামে এক চালকের। তিনি ট্যাক্সিটি রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে কলে মুখ ধুচ্ছিলেন। চাবি রাখা ছিল ট্যাক্সিতেই। অভিযোগ, এক যুবক গাড়িতে বসে সেটি চালিয়ে চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করে। ঘটনাটি দেখে ছুটে গিয়ে চালকের হাত-সহ স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করেন ফিরোজ। তাতেই ট্যাক্সিটি বেসামাল হয়ে দু’টি বাতিস্তম্ভে ধাক্কা মারে। ফিরোজ ছিটকে পড়ে গাড়ির নীচে পিষে যান। ঘটনাস্থল থেকেই পুলিশ গ্রেফতার করে অভিযুক্ত যুবককে। তাকে জেরা করেই গাড়ির চোরা কারবারের এমন নানা তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
গাড়ি চুরি চক্রের তদন্তে যুক্ত লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘চোরাই বাজারে মাহিন্দ্রা কোম্পানির স্করপিয়ো গাড়ির নাম চিতা। হুন্ডাইয়ের স্যান্ট্রো পরিচিত সন্তুর (বাদ্যযন্ত্র) নামে। মারুতি কোম্পানির সুইফ্ট আবার মেন্ডক বা ব্যাঙ নামে খ্যাত। ওয়াগন-আর গাড়ির তেমনই পরিচয় বেগুন নামে। হুন্ডাইয়ের আর একটি গাড়ি আই ১০-কে ডাকা হয় অ্যাপল নামে। অ্যাম্বাসাডর লোহা নামে পরিচিত।’’
ওই পুলিশকর্তা জানান, চুরি করা গাড়ি দু’ভাবে চোরাই বাজারে কাজে লাগানো হয়। প্রথমে বোঝার চেষ্টা হয়, গাড়ির মালিক কতটা প্রভাবশালী। অর্থাৎ, পুলিশ সেই সূত্র ধরে অভিযুক্তদের কাছে পৌঁছতে পারবে কিনা। যদি ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রথমেই গাড়িটি কাটাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এর পরে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে সেগুলি চড়া দামে বিক্রি করা হয়। কিছু যন্ত্রাংশ ভিন্ রাজ্যে এবং দেশের বাইরেও পাচার করা হয়। লালবাজারের চুরি দমন শাখার এক অফিসারের কথায়, ‘‘এক বার কাটাই হয়ে গেলে গাড়ি ফেরত পাওয়ার কোনও আশা নেই। গাড়িটি কে চুরি করেছিল, সেটাও ধরা সম্ভব নয়।’’
অন্য দিকে, যে গাড়ি থেকে বিপদ তেমন নেই বলে মনে করা হয়, সেই গাড়ি পাচার হয়। নম্বর প্লেট পাল্টে লরি করেও প্রচুর গাড়ি ভিন্ রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয় বলে খবর। মূলত ঝাড়খণ্ড, বিহারের ডিলারেরা এমন গাড়ি কেনেন। চোরাই বাজারে একটি ১০ লক্ষ টাকার গাড়ি এক থেকে দেড় লক্ষ টাকায় অনায়াসে বিক্রি হয়ে যায়। পুলিশ জেনেছে, জ়াকারিয়া স্ট্রিটের গাড়িটি নিয়ে গিয়ে কাটাই করে যন্ত্রাংশ বিক্রিরই পরিকল্পনা ছিল।
পুলিশ সূত্রের খবর, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে প্রতি ১২ মিনিটে দেশে একটি করে গাড়ি চুরি হয়েছে। গাড়ি এবং তার যন্ত্রাংশ চুরির নিরিখে প্রথম স্থানে দিল্লি। এমন ঘটনার ৫৬ শতাংশ অভিযোগই দায়ের হয়েছে সেখানে। পশ্চিমবঙ্গে দায়ের হয়েছে ২৬ শতাংশ অভিযোগ। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে যেখানে গোটা দেশে ১০ লক্ষ গাড়ি এবং তার যন্ত্রাংশ চুরির অভিযোগ জমা পড়েছিল, সেখানে পরের তিন বছরে (২০২১-২০২৩) এমন চুরির অভিযোগ দায়ের হয়েছে ২৮ শতাংশ বেশি। লকডাউন থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে গত তিন বছরের প্রতি বার গড়ে গাড়ি চুরি গিয়েছে ৫০ হাজার। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্তা বলেন, ‘‘কলকাতায় গাড়ি চুরির থেকেও বেশি সেটির যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে। আর চুরি হচ্ছে মোটরবাইক। তাই রাস্তায় গাড়ি রাখার ব্যাপারে মালিকদেরই সতর্ক হতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy