Advertisement
E-Paper

জমা জল আর আবর্জনায় খুব ভোগান্তি হয়

আমার জন্ম ১৯২৪ সালে। সেই থেকে প্রায় ৯২ বছর এখানে আছি। সে এক সময় ছিল। পাড়ার প্রতিটা বাড়ির মধ্যে মিলমিশ ছিল খুব। আমার মেয়েরা স্কুল থেকে ফিরে সাইকেল নিয়ে পাড়ায় টো-টো করত। ছুটির দিনে এ বাড়ি-সে বাড়ি ঘুরে মা-কাকিমাদের হাতে হাত লাগিয়ে সব্জি কুটে দিত।

মণীশ প্রধান

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৫ ০০:৪০

আমার জন্ম ১৯২৪ সালে। সেই থেকে প্রায় ৯২ বছর এখানে আছি।

সে এক সময় ছিল। পাড়ার প্রতিটা বাড়ির মধ্যে মিলমিশ ছিল খুব। আমার মেয়েরা স্কুল থেকে ফিরে সাইকেল নিয়ে পাড়ায় টো-টো করত। ছুটির দিনে এ বাড়ি-সে বাড়ি ঘুরে মা-কাকিমাদের হাতে হাত লাগিয়ে সব্জি কুটে দিত। পাড়ার ছেলে-মেয়েরা মিলে বিকেলে হুল্লোড় করত। এখন সময় কোথায়?

জয় মিত্র স্ট্রিট, তারক চ্যাটার্জি লেন, আরতি গুপ্ত সরণি ছাড়িয়ে অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট হয়ে গ্রে স্ট্রিট— পুরোটাই আমার পাড়া। শোভাবাজার মানেই পুরনো কলকাতা। পুরাতনী গায়ক রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিশিষ্ট গায়ক বিমান মুখোপাধ্যায়, ভাস্কর বিপিনবিহারী গোস্বামীর মতো নামী-দামি মানুষের বাস ছিল এখানে। অবিনাশ ছিলেন বিখ্যাত কবিরাজ। তাঁর অব্যর্থ দাওয়াইয়ে আস্থা রেখে ভিড় জমাতেন বহু মানুষ। এত ভিড় হত যে, চার-পাঁচটা চা-চপের দোকানও বসে গিয়েছিল। পরে অবশ্য সে সব উঠে যায়। তাঁর নামেই হয় অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট। ইংলিশ চ্যানেল জয়ী প্রথম বাঙালি মেয়ে আরতি, অরুণ গুপ্তকে বিয়ে করে এ পাড়ার বাসিন্দা হয়েছিলেন। এখন সেই রাস্তার নাম হয়েছে আরতি গুপ্ত সরণি।

আগে ভোরবেলা পাড়ায় পাড়ায় ঝাঁট পড়ত, ভিস্তিওয়ালারা জল দিয়ে যেত। এখনও পুরসভা সাধ্যমতো চেষ্টা করে ঠিকই। কিন্তু লোকজনই যদি রাস্তা নোংরা করে রাখেন, তা হলে কী করে পরিষ্কার থাকবে পাড়া?

পাড়ার মোড়ে যে বাড়িটা ছিল, সেখানে এখন নতুন লোক এসেছে। আর একটা বাড়ি ভেঙে পড়েছে প্রায়। অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিটে সুধীর পাল যেখানে ঠাকুর গড়তেন, সেই জায়গাটায় ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে। আগে দেখেছি, পাড়ায় গল্প-গুজবের চলটা ছিল বেশি। আমাদের বাড়ির তিনতলার ছাদের পাঁচিল থেকে হাত বাড়িয়ে ও বাড়ির জানলা দিয়ে খাবার যেত। আমার বাড়ি থেকে গিন্নি গোকুল পিঠে পাঠালে ওই বাড়ি থেকে আসত মোচার ঘণ্ট। এখন আর সেই আন্তরিকতা নেই। অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট আর তারক চ্যাটার্জি স্ট্রিটের মোড়ে অরুণ গুপ্তের বাড়ির সামনে যে দুর্গাপুজো হয়, সেটা আমার পাড়ার পুজো। এখন শুধু সন্ধিপুজোর দিনে মণ্ডপে পাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে দেখা হয়। পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডার চলটা একদম হারিয়ে গিয়েছে। একটু-আধটু পরিবর্তন তো আসবেই। বেশির ভাগ বাড়ি একই রকম আছে, বদলে গিয়েছে শুধু ভিতরের মানুষগুলো।

এখন দেখি পাড়ায় এক হাত দূরে দূরে খাবারের দোকান হয়েছে। এখানকার ‘ইজ্জতদার’ খাবার পাওয়া যায় মিত্র কাফেতে। আজও বাড়িতে অতিথি এলে মিত্র কাফে থেকে ফিশ ফ্রাই, হাল্কা চিকেন স্ট্যু আসে। রাস্তার ওপারে আছে অ্যালেন’স্ কিচেন। মানে ফিশ কাটলেট, চিংড়ির কাটলেট। বাজার বলতে একমাত্র শোভাবাজার। আজও বৃষ্টি হলে জল জমে খুব। বেশ কিছু নর্দমা তৈরি হলেও বর্ষায় খুব ভোগান্তি হয়।

ইদানীং পাড়ার পরিবেশের অবনতি হচ্ছে। পাশেই মাঠকোটা বস্তি। আগেও বস্তি ছিল। দিন-দিন লোকসংখ্যা বাড়ছে। রাস্তা অপরিষ্কার থাকে। সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যা প্রায় ৭টা-সাড়ে ৭টা পর্যন্ত চলে খেলাধুলো। ফলে বিশ্রাম নিতে সমস্যা হয়। চাইলেই তো শহরটাকে লন্ডন করে ফেলা যায় না। লোকগুলোকেও লন্ডনবাসীর মতো হতে হবে যে!

পাড়ার দু’টো ক্লাব ‘অবিনাশ’ আর ‘আলোচনা’। অবিনাশ-এর ছেলেরা খেলাধুলো নিয়েই থাকে। আলোচনা কালচারাল ক্লাব। বসে আঁকো, স্পোর্টস ডে পালন-সহ নানা কাজে এগিয়ে আসে এরা। পাড়ায় তেমন গোলমাল নেই। এক বার কিছু ছেলে বাড়ির সামনে বোমা ফাটাচ্ছিল। শত বারণেও শোনেনি। ভয়ে আমাদের কুকুরটা মারা গিয়েছিল। কষ্ট পেয়েছিলাম।

একটা কথা বলতেই হয়। এখানে মেয়েদের নিরাপত্তাটা খুব কম। আগের তুলনায় কমছে। পাশেই সোনাগাছি। তবে ‘ওঁরা’ খুব ভদ্র। সমস্যা হয় যখন দালালেরা পাড়ায় প্রথম আসা আমার কোনও আত্মীয়াকে চিনতে পারেন না। এক বার বড়তলা থানায় অভিযোগও জানিয়েছিলাম। ‘আলোচনা’ ক্লাব এই নিয়ে বহু অভিযোগ, প্রতিবাদ করেছে। তেমন লাভ হয়নি। পুলিশ রুটিন মাফিক ঢুঁ মেরে যায়। তবে লক্ষ করেছি ‘ওঁদের’ দাঁড়ানোর পরিসরটা বেড়েছে। আগে সোনাগাছিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন বাঁ দিকে নরেন দেব পার্ক থেকে শুরু করে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ধরে সেই লিবার্টি সিনেমা হল অবধি ওঁরা থাকেন। ওঁরাই বা কী করবেন। পেটের দায়ে আসা গ্রামের মেয়ে সব! আমি ও আমার মেজ মেয়ে ‘দুর্বার’-এর মেডিক্যাল টিমে ছিলাম। ওরা ভালো কাজের চেষ্টা করে।

ভাল-খারাপ সব মিশিয়েই এই পাড়া আমার। বহু চেনা মুখ হারিয়ে গিয়েছে। কত কাছের মানুষ চলে গিয়েছেন অন্য কোথাও। আমারও কখনও কখনও যে সে রকম মনে হয়নি, তা নয়। তবে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে জানলা খুলে সামনের বাড়ির চেনা ছেলেটার মুখ আর দেখতে পাব না— এটা ভেবেই আর কোনও দিন যাওয়া হয়নি কোথাও।

লেখক বিশিষ্ট চিকিৎসক

waterlogging garbage grey street shovabazar grey street garbage amar para manish pradhan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy