Advertisement
E-Paper

‘এই বাজিই তো পাবলিক ডিম্যান্ড, পুলিশ কী করবে’

সাত-সকালে কারখানার গেটের সামনে ভ্যানটা এসে দাঁড়াল। ভ্যানের মধ্যে আগে থেকেই বেশ কয়েকটা বস্তা। কী আছে তাতে! ভাবতে ভাবতেই কারখানা থেকে কয়েক বস্তা চকোলেট আর আলু বোমের বস্তা হাতে হাতে তুলে দেওয়া হল ভ্যানে।

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৬ ০২:১২
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সাত-সকালে কারখানার গেটের সামনে ভ্যানটা এসে দাঁড়াল। ভ্যানের মধ্যে আগে থেকেই বেশ কয়েকটা বস্তা। কী আছে তাতে! ভাবতে ভাবতেই কারখানা থেকে কয়েক বস্তা চকোলেট আর আলু বোমের বস্তা হাতে হাতে তুলে দেওয়া হল ভ্যানে। সেগুলি মাঝখানে রাখা হল। কৌতুহল বাড়ছে...। তা হলে আগের বস্তাগুলোতে কী আছে?

কিন্তু কিন্তু করে প্রশ্নটা করেই ফেললাম ভ্যানের খালাসিকে। যা বলল, তাতে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। ‘‘ওই বস্তাগুলোয় কাঁচা সুপারি আছে। চকোলেট আর কাঁচা সুপারি আকারে প্রায় এক।’’ ছেলেটা বলে চলে, ‘‘ভ্যানের সামনে-পিছনে সুপারি, মাঝখানে চকোলেটের বস্তা রাখি। কেউ বুঝতে পারবে না।’’ প্রায় যুদ্ধজয়ের হাসি দিয়ে ছেলেটা ভ্যানে উঠে পড়ল। গাড়ি রওনা দিল কলকাতার উদ্দেশে। কারখানার মালিক বললেন, ‘‘ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবে।’’

সম্প্রতি শব্দবাজিকে আরও এক বার ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করেছেন রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সেই ঘোষণার ফল কী হল, তার আঁখো দেখা হাল বুঝতে পৌঁছে গিয়েছিলাম দক্ষিণ শহরতলির চম্পাহাটি-নুঙ্গি-বজবজ এলাকায়। সাধারণ মানুষ তো বটেই। পুলিশ-প্রশাসনও এই সব এলাকাকে শব্দবাজির আঁতুড়ঘর বলেই মানে। শুক্রবার সকালে এমনই একটি আঁতুড় ঘরের সামনে গিয়েই ভ্যানে করে চকোলেট-আলুবোম যাওয়ার ছবিটা চোখে পড়ল।

কিন্তু এ সব তো নিষিদ্ধ? মন্ত্রী তো সেটাই জানিয়েছেন। প্রশ্ন শেষ করার আগেই প্রায় রে রে করে উঠলেন মালিক। কারখানার ভিতরে তখন চকোলেট বাক্সবন্দি করার কাজ চলছে। কোনও রাখঢাক নেই। সবই চলছে প্রকাশ্যে। আমার প্রশ্ন শুনে কয়েক জনকে ডেকে নিলেন মালিক। তার পরে শুরু হল নিষিদ্ধ বাজির স্বপক্ষে যুক্তি। কেউ বললেন, ‘‘নিষিদ্ধ বাজি গরিবের বাজি। এর তৈরি থেকে বিক্রি — সবই করেন গরিব, পিছিয়ে পড়া মানুষ। সারা বছর বাজি তৈরি হলেও এটাই হল মরসুম। এই সময়ে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়। প্রচুর চাহিদা। এই টাকায় কত সংসারের পেট চলে।’’ আর এক জনের সাফ কথা, ‘‘আমরা বিক্রি করি না। লোকে এসে কিনে নিয়ে যায়।’’

ঘটনাও তাই। ওই সকালেই প্রায় প্রতিটি কারখানা এবং অস্থায়ী দোকানে উপচে পড়ছে ক্রেতাদের ভিড়। ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষেরই বেপরোয়া মনোভাব। এমনই এক জন সর্দারজি। নিজের ইনোভা গাড়ি হাঁকিয়ে চকোলেট কিনতে এসেছেন বড়বাজার থেকে। আগে থেকেই বরাত দেওয়া ছিল। তাই তাঁকে দেখেই কারখানার মালিক চিৎকার করে কাজের ছেলেটাকে বললেন, ‘‘সর্দারজির ১০ বস্তা মাল গাড়িতে তুলে দে।’’ কিন্তু এত নিষিদ্ধ বাজি কোথায় বিক্রি করবেন? দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে সর্দারজি বললেন, ‘‘বিক্রি করব না। লোকে এসে নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাবে। সব অর্ডার রয়েছে। একটাও পড়ে থাকবে না।’’ সর্দারজির কথা শুনে মালিক ততধিক উৎসাহিত। ‘‘বললাম না, এ বাজি বিক্রি করতে হয় না। এটা পাবলিক ডিমান্ড। পুলিশ কিচ্ছু করতে পারবে না।’’

কত চকোলেট বিক্রি করে দক্ষিণের এই সব এলাকা? লাভই বা কত?

ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু মরসুমের তিন মাসেই এক কোটির বেশি চকোলেট তৈরি হয়। সব বিক্রি হয়ে যায়। ১০০টি চকোলেট তৈরি করতে খরচ পড়ে ২৫ টাকা। তা বিক্রি করা হয় ১২৫ টাকায়। এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘তা হলেই বুঝতে পারছেন, কত মুনাফা হয়।’’ তিনি বলে চলেন, মরসুমের সময় এখানে সকলেই চকোলেট তৈরি করে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে থেকে গৃহবধূ। বাড়িতে রান্নার পরে একই ঘরে বসে চকোলেট তৈরি হয়। কুটির শিল্পের মতো। আমরা মজুরি দিয়ে তা কিনে নিই।’’ এ ছাড়াও রয়েছে প্রায় হাজার খানেক কারখানা এবং অস্থায়ী দোকান।

এত আয়োজন, অথচ পুলিশ কিছুই জানে না? জেলা পুলিশের একাংশেরই বক্তব্য, বড় কর্তারা সবই জানেন, দেখেন। তবে চোখ বুঝে থাকেন। জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য বলছে, ওই তিন এলাকা থেকে সাম্প্রতিক কালে ৬৫ হাজার চকোলেট বোমা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। যা আসলে সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। কিন্তু কোনও গ্রেফতার নেই। কেন? ওই অংশের বক্তব্য, পুলিশ যাওয়ার খবর আগাম পেয়ে যান ব্যবসায়ীরা। তাই তাঁদের ধরা যায় না। তা ছাড়া ওই সব এলাকায় অভিযান চালালে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যাও হতে পারে। তাই কেউ ঘাটায় না। আর নুঙ্গি, মহেশতলার লোকেদের বক্তব্য, পুলিশ অভিযান চালায়, আবার লোক পাঠিয়ে চকোলেট নিয়ে যায়। রাজনৈতিক নেতারাও তাই করেন। যা শুনে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক পুলিশকর্তার অভিযোগ, ‘‘পুলিশের নাম ভাঙিয়ে কেউ হয়তো এ সব করেন।’’

Public demands Sound crackers Police
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy