Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ভাইফোঁটার মিষ্টিমুখে নতুন স্বাদের ঝোঁক

সাবেক মিষ্টি পিছনে ফেলে অন্য স্বাদেই ভাইফোঁটা বেহালা, সোদপুর ও আসানসোল থেকে তুতো বোনেরা নিউ আলিপুরের বাড়িটায় জড়ো হতে শুরু করেছেন। রবি-বিকেলে বিমানবন্দরে নেমে বাড়ি ঢোকারও আগে মিষ্টির প্যাকেট বগলদাবা করলেন কৃশানু সেনগুপ্ত।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৩৬
Share: Save:

সাবেক মিষ্টি পিছনে ফেলে অন্য স্বাদেই ভাইফোঁটা

বেহালা, সোদপুর ও আসানসোল থেকে তুতো বোনেরা নিউ আলিপুরের বাড়িটায় জড়ো হতে শুরু করেছেন। রবি-বিকেলে বিমানবন্দরে নেমে বাড়ি ঢোকারও আগে মিষ্টির প্যাকেট বগলদাবা করলেন কৃশানু সেনগুপ্ত।

বেঙ্গালুরুর তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীর এখনও পছন্দ ভবানীপুরের শতাব্দীপ্রাচীন সাবেক মিষ্টি-বিপণি। কিন্তু সেকেলে ঢাউস খাজা, ভাইফোঁটা-ছাপ কড়াপাক সন্দেশের দিকে না-ঘেঁষে কেজি দুয়েক বেক্‌ড মিহিদানা ও কাপ-বন্দি বেক্‌ড মিষ্টি অ্যামব্রোজিয়া কিনে ফেললেন তিনি।

নিউ টাউনের প্রবীণ বাসিন্দা অপরেশ ভট্টাচার্যেরও যে-সে দোকানের সন্দেশ মুখে রোচে না। এই দুপুরে সিমলের সাবেক সন্দেশ-স্রষ্টার ঠেকে এক কোণে ঝাড়া এক ঘণ্টা কাঙ্ক্ষিত মিষ্টি পাক হওয়া অবধি চুপচাপ অপেক্ষা করলেন। ওই তল্লাটের নলেন গুড়ের জলভরা, কাঁচাগোল্লা সবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছে, তা প্রাণে ধরে উপেক্ষা করা যায় না। তবু নতুনত্বের টানে মিহি সরে মোড়া সন্দেশের পুরঠাসা নবীন শিঙাড়া ও ‘মধু সর’, না নিয়ে অপরেশবাবু উঠলেন না। বললেন, ‘‘আমার শ্যালকেরা সক্কলে আবার ডাক্তার। বড্ড স্বাস্থ্যসচেতন। কিছু কম মিষ্টি সন্দেশ ও নতুন ধরনের সন্দেশ— সবই মজুত থাকুক।’’

শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ— মিষ্টির রুচিতে এমনই পরিবর্তনের হাওয়া। কয়েক বছর আগেও ভাইফোঁটায় থালা ভরা ঘিয়ে ভাজা সুগন্ধী খাজা, মাতৃভোগ, চিত্রকূট, দরবেশ, ভাইফোঁটা-ছাপ সন্দেশ ইত্যাদির সমাবেশই শেষ কথা ছিল। এখনও সে-সব সাজিয়ে দেওয়ার পাট চুকে গেছে বলা যাচ্ছে না। তবে কম মিষ্টি, অন্য ধরনের স্বাদের দিকে ঝোঁকটাই খানিক বেশি। বলরামের দোকানের কর্ণধার সুদীপ মল্লিকের কথায়, ‘‘আমরা এখনও মাটির থালায় প্রদীপ-ধানদুব্বোযোগে সাবেক মিষ্টির প্যাকেজ দিচ্ছি। কিন্তু ও-সবের কদর মেরেকেটে ১০ ভাগ খদ্দের করেন।’’ তাঁর দাবি, সাবেক জলভরার সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে মিষ্টির যাবতীয় বেক্‌ড অবতার। বেক্‌ড রসগোল্লা, মিহিদানা, দই বা সন্দেশ।

তবে এই প্রবণতা মোটেও নিছক দক্ষিণ কলকাতার ব্যাপার নয়। মফস্‌সল রিষড়ায় ফেলু ময়রার দোকানেও বেক্‌ড মিষ্টির প্রতি টান টের পাচ্ছেন কর্ণধার অমিতাভ মোদক। তাঁর কথায়, ‘‘বেক্‌ড মিষ্টিতে মিষ্টির ভাগ কম। গুরুপাকও নয় ততটা। হয়তো এটাই চাহিদার কারণ।’’ কলকাতার আর এক হেভিওয়েট কে সি দাশের কর্তা ধীমান দাশও বলছেন, এই ভাইফোঁটায় সাবেক রাজভোগ, রসমালাইদের সঙ্গে লড়ে জায়গা করে নিয়েছে ছানার মোড়কে কোকো সন্দেশ-ভরা বাদশাহি চকোরোল বা চমচম, দরবেশ, সন্দেশের ককটেল বিনয়শ্রী। নোনতার মধ্যেও সাবেক শিঙাড়াকে চাপে রেখেছে আলুর বদলে আমেরিকান কর্ন, মোজারেলা চিজঠাসা শিঙাড়া ইতালিয়ানো।

কোনও কোনও পোড়খাওয়া মিষ্টি-রসিকের আফশোস, নতুনের প্রতি ঝোঁকে সাবেক মিষ্টির খুবই অনাদর। বাংলার ঐতিহ্যলালিত বহু সৃষ্টি মুছে যাচ্ছে। সিমলের নকুড়ের জনৈক প্রয়াত কর্তা প্রশান্ত নন্দী একদা বলতেন, এটাই স্বাভাবিক। শহরের রাস্তায় ক্রাইসলার, অস্টিন গাড়িও তো এখন দেখা যায় না। নকুড়ের বর্তমান ছোট কর্তা প্রণব নন্দীর দাবি, সাবেক গুড়ের জলভরা, কাঁচাগোল্লা, পারিজাতদের সঙ্গে এখন বাটারস্কচ, চকোলেটের ব্ল্যাক ফরেস্ট বা সরের কিছু নতুন মিষ্টি পাল্লা দিচ্ছে।

তবু ভাইফোঁটার আবহে কিছু পুরনো মিষ্টিও খানিক স্বমহিমায়। আজ, সোমবার প্রতিপদ ও কাল, মঙ্গলবার দ্বিতীয়া— দু’দিনই ভাইফোঁটা। বৌবাজারের ভীমনাগের দোকানে এ সময়ে ভাজা মিষ্টি, রকমারি গজা, লবঙ্গলতিকা, ক্ষীরকান্তির আলাদা কাউন্টার হয়। কর্ণধার প্রদীপ নাগ হাসলেন, জাফরানের ভাইফোঁটা স্পেশাল ঢাউস শকুন্তলা সন্দেশটিও শুধু এ সময়ে আত্মপ্রকাশ করে। বাঙালি যাতে সাবেক স্বাদগুলো ভুলে না-যায়, সে-দিকে খেয়াল রাখেন ফেলু ময়রাও। ঘিয়ে ভাজা খাস্তা নোনতা, মিষ্টি খাবার তৈরিতে তুখোড় ওই মিষ্টি-শিল্পীরা, পুজোর পর থেকেই ৯১ রকমের নতুন-পুরনো মিষ্টির তালিকা লিফ্‌লেটের মতো জনে-জনে বিলি করেন।

কিছু পরিবর্তন সকলেই মানছেন। মিষ্টি-স্রষ্টারা বুঝেছেন, বিজয়া বা ভাইফোঁটা, স্রেফ মিষ্টির মাপে ভুলবে না কেউ। স্বাদটাই এখন শেষ কথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bhai Phonta Sweets
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE