Advertisement
E-Paper

ছাতা মাথায় রাতভর পথে পার্ক সার্কাস

কেউ কেউ বাড়ি থেকে ব্যাগে কম্বল নিয়ে এসেছেন। সেটা ছড়িয়ে দিচ্ছেন অচেনা প্রতিবেশীর পায়ে।

চৈতালি বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২০ ০২:২২
সম্মিলিত: কচিকাঁচাদের নিয়ে অবস্থান-বিক্ষোভে মহিলারা। সেখানেই এক পাশে নমাজ পড়ছেন অনেকে। রবিবার, পার্ক সার্কাসে। ছবি: মেহবুব কাদের চৌধুরী

সম্মিলিত: কচিকাঁচাদের নিয়ে অবস্থান-বিক্ষোভে মহিলারা। সেখানেই এক পাশে নমাজ পড়ছেন অনেকে। রবিবার, পার্ক সার্কাসে। ছবি: মেহবুব কাদের চৌধুরী

শীতটা একটু বেশিই। রাত যত বাড়ছে, স্লোগানের সুর চড়ছে পার্ক সার্কাসে। মেয়েদের হাতে হাতে ঘুরছে বড় কালো ছাতা। তার গায়ে সাদায় লেখা ‘নো এনআরসি’। কনকনে শীতের রাতে মাথায় হিম পড়া থেকে বাঁচতে এই বুদ্ধি বাতলানো হয়েছে। কোলে দুধের শিশু নিয়ে পার্ক সার্কাসের প্রতিবাদে রাত কাটানো মায়েদের মাথার উপরে ছাউনি খাটানোর অনুমতি পাওয়া যায়নি। অগত্যা ঠান্ডা থেকে বাঁচতে রাতভর চলেছে ছাতা মাথায় আজাদির স্লোগান।

হাতে গোনা শৌচাগার। খুব পরিষ্কারও নয়। তাই চা-জল খেতে ভয় পাচ্ছেন কোনও কোনও মেয়ে। কাউকে আবার ঋতুকালীন যন্ত্রণার ওষুধ খেয়ে আসতে হয়েছে। তাতেও স্লোগানের তীব্রতা কমেনি।

কেউ কেউ বাড়ি থেকে ব্যাগে কম্বল নিয়ে এসেছেন। সেটা ছড়িয়ে দিচ্ছেন অচেনা প্রতিবেশীর পায়ে। ঠান্ডার আক্রমণে যেন যুদ্ধ ময়দানের সহ-সৈনিক পরাস্ত না হয়। মেয়েদের মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তোলা। আজাদি স্লোগানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীরী বিভঙ্গে ঝরছে প্রতিবাদ। হিজাব-নাকাবে ঢাকা মুখগুলোর ভিতর থেকে যে এমন দৃপ্ত কণ্ঠ ভেসে আসছে, তা রাতের পার্ক সার্কাসকে স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।

শনিবার রাতে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দু’দিনের কলকাতা সফরে এসে বেলুড় মঠে ঠাঁই নিয়েছেন, যখন ভোর-ভোর উঠে তাঁর গঙ্গার তীরে ধ্যান করার জল্পনা শোনা যাচ্ছে, ঠিক তখনই বিনিদ্র রাত জাগছেন শফকত, আয়েশা, সালমা-রা।

পাশাপাশি: রাতভর ঠান্ডা থেকে বাঁচতে ‘নো এনআরসি’ লেখা এই ছাতাই ভরসা আন্দোলনকারীদের। শনিবার রাতে, পার্ক সার্কাসে। নিজস্ব চিত্র

স্লোগানের ফাঁকে ফাঁকে মাইকে জানিয়ে দেওয়া হল, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মতলায় মোড়ে অবস্থানরত বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ভাই-বোনেরাও রাত জাগছেন। পাশে থাকার বার্তা দিতে তাঁদের কাছে পৌঁছে যাওয়া সকাল বেলা। আর এক দল যাবে নেতাজি ইন্ডোরের সামনে প্রতিবাদ জানাতে। তাই বাড়ি গিয়ে যেন মহিলারা খানিক বিশ্রাম নেন।

আরও পড়ুন: ছবি একই আছে, শুধু ‘পাল্টে’ গিয়েছে ভারতমাতার অর্থ

লাল টুপিতে ঢাকা, বছর দুয়েকের কোলের সন্তান তত ক্ষণে ক্লান্তির ঘুমে ঢুলে পড়েছে মায়ের কোলে। কিন্তু পার্ক সার্কাসের মেয়েরা বসে রইলেন।

পাশের এলাকা থেকে এসেছিলেন বছর চব্বিশের আয়েশা খাতুন। কোলে দেড় বছরের মেয়ে সৈনব খাতুন ঘুমে কাদা। মিছিলের একদম সামনের দিকে বসে আজাদি স্লোগানে গলা মেলাচ্ছিলেন। জানালেন, বেলুন বিক্রি করেন। স্বামী কাজ করেন জুতোর কারখানায়।

আরও পড়ুন: ‘সারাদিন কোনও কাজ হয়নি, এ বার দেশের কাজ করতে হবে’

মেয়েকে খাইয়েছেন? প্রশ্নটা করতে লজ্জা লজ্জা মুখ করে মাথা নাড়লেন। এত রাতে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন, স্বামী রাগ করবে না? কাপড়ে মুখ ঢেকে হাসিতে গড়িয়ে পড়লেন আয়েশা। তার পরে নিচু গলায় বললেন, ‘‘স্বামী গালাগালি করে! তা-ও আসি। যদি দেশ থেকে বার করে দেয়, তখন কী করব?’’

ঘড়ির কাঁটা ছুটছে। রাত ১টা ২০ নাগাদ ‘গো ব্যাক মোদী’ স্লোগানে গমগম করে উঠল পার্ক সার্কাস ময়দান। মাইকে ঘোষণা হল— ‘‘যতক্ষণ মোদী কলকাতায় আছেন, আমরা রাজপথ ছাড়ব না।’’

ঠিক তার পাশেই পোস্টার নিয়ে মারপিট করতে করতে ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে দুটো বাচ্চা। বছর তেরোর স্কুলছুট মেয়েটি পাশেই থাকে। নাম তানিয়া খাতুন। ওর বাড়ির গলিরই বছর আটেকের ছেলেটা ওর পোস্টার ছিনিয়ে নিয়েছে। তাই এই— বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।

তানিয়া বলে, ‘‘আমার তো স্লোগানগুলো সব মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। স্কুলে খালি ফেল করতাম বলে নাম কাটা গেল। মা-ও আর পয়সার জন্য ভর্তি করেনি। আমি পড়তে চাই। একটা আন্টির বাড়ি ঘর মোছা, বাসন ধোয়ার কাজ করি। আমায় থাকতে দেয়। রাতে এখানে আসি।’’

রাত তিনটে। আজাদি স্লোগানের পরিবর্তিত সংস্করণ শোনা গেল। মাইকে স্লোগান— ‘মোদী বেহরা শুনলে’। তা ছাপিয়ে মেয়েদের গলা— ‘আজাদি’।

জমায়েতের মূল ভিড় থেকে একটু দূরে বসেছিলেন তিন বন্ধু। তাঁদের এক জন মৌলানা আজাদ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী লুবনা রহিম। মেটিয়াবুরুজ থেকে পার্ক সার্কাসে আসছেন রোজ। খোলা আকাশের নীচে রাতে কাটাচ্ছেন।

লুবনা বলছেন— ‘‘এখনও যাঁরা মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরোতে দিচ্ছেন না, তাঁদের তো এক দিন দেশ থেকেই বার করে দেবে। ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাবে। তখন কোথায় যাবেন তাঁরা?’’

রাত সাড়ে তিনটে। গবেষক আয়েশা জামান তখন প্রতিবাদে যোগ দিতে আসা সদ্য-পাতানো বন্ধু রায়া দেবনাথকে বোঝাচ্ছেন, কেন গত এক বছর ধরে তিনি ফের নিয়ম মেনে হিজাব পরা শুরু করেছেন। রায়া তাঁকে বোঝাচ্ছেন পুরুষতান্ত্রিকতার খাপগুলি। পাশে বসা স্মিতা খট্টর তাঁকে এগিয়ে দিচ্ছেন জলের বোতল।

লুবনা বলে চলেন, ‘‘মোদী চেয়েছিলেন দেশে হিন্দু-মুসলমান আলাদা করতে। তাতে আমরা সবাই আরও বেশি এক হয়ে গিয়েছি। এখানে কেউ আর আলাদা নেই।’’

পিছনে তখন স্লোগান উঠছে— ‘আওয়াজ দো, হাম এক হে’।

Protest Park Circus CAA NRC Citizenship Amendment Act
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy