Advertisement
১৯ মে ২০২৪

যোগ-বিধির গণ্ডি ছাড়িয়েই কি মৃত্যু দেবযানীর

কী ভাবে মারা গেলেন রবিনসন স্ট্রিটের দেবযানী দে, সেই রহস্য এখনও ভেদ করা যায়নি। তবে গোয়েন্দাদের দাবি, যোগসাধনায় অসঙ্গতি বা অসম্পূর্ণতা থেকেও তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে বলে যোগশিক্ষকেরা তাঁদের জানিয়েছেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৫ ০২:৫২
Share: Save:

কী ভাবে মারা গেলেন রবিনসন স্ট্রিটের দেবযানী দে, সেই রহস্য এখনও ভেদ করা যায়নি। তবে গোয়েন্দাদের দাবি, যোগসাধনায় অসঙ্গতি বা অসম্পূর্ণতা থেকেও তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে বলে যোগশিক্ষকেরা তাঁদের জানিয়েছেন।

প্রাণত্যাগের সঙ্কল্প করে প্রায়োপবেশন অর্থাৎ খাদ্য-পানীয় বর্জনের অজস্র দৃষ্টান্ত আছে শাস্ত্রে-পুরাণে। দেবযানী খাওয়াদাওয়া এবং জলপান বন্ধ করে ধ্যান ও যোগসাধনা করতেন। যে-আশ্রমের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে ওই মহিলা যোগসাধনা শুরু করেন, গত সপ্তাহে দক্ষিণেশ্বরের সেই যোগদা সৎসঙ্গ সঙ্ঘের দ্বারস্থ হন তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, দেবযানী যোগসাধনায় যোগ দিলেও তা শেষ করেননি বলে আশ্রম-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। ওই আশ্রমের বক্তব্য, অন্নজল ত্যাগ করে যোগ অভ্যাসের শিক্ষা তারা দেয় না। অর্থাৎ খাদ্য-পানীয় ছেড়ে দেবযানী যোগ-বিধির গণ্ডি ছাড়িয়েছিলেন।

দেবযানী যে যোগসাধনা করতেন, তাঁদের বাড়িতে পাওয়া বিভিন্ন ডায়েরি ঘেঁটেই তা জানতে পেরেছিল পুলিশ। কিন্তু ওই সাধনায় তিনি কতটা দক্ষ ছিলেন, যোগানুশীলনের বিধি কতটা ভেঙেছিলেন, সেই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে তদন্তকারীদের মধ্যে। প্রশ্ন উঠছে, যোগসাধনা শুরু করেও যথাযথ ভাবে তা সম্পূর্ণ না-করাতেই কি ওই মহিলার মৃত্যু হয়েছে?

‘যথাযথ ভাবে সাধনা না-করা’ বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে?

সরাসরি সবিস্তার জবাব মিলছে না। তবে খুব মোটা দাগের অসঙ্গতি হল:

যোগসাধনার জন্য খাওয়াদাওয়া ও জলপান ছেড়ে দিয়েছিলেন দেবযানী।

দিনের পর দিন ধ্যানমগ্ন থাকতেন। বিভিন্ন ডায়েরি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাঁর ভাই পার্থ দে-ও পুলিশের কাছে এমনটাই দাবি করেছেন। অথচ দেবযানী যে-আশ্রমে যোগসাধনা শিখেছিলেন, সেখানে পুলিশ জেনেছে, যোগশিক্ষা দিতে গিয়ে তাঁরা খাদ্যগ্রহণ ও জলপান ছাড়তে বলেন না। দীর্ঘ সময় ধ্যান করার মতো কোনও ক্রিয়া বা যোগও কাউকে শেখান না। বরং স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া বজায় রেখেই যোগ শেখানো হয়। খাদ্য-পানীয় ত্যাগ ওই সাধনার অঙ্গ নয়। একটানা দীর্ঘ ক্ষণ ধ্যানের শিক্ষাও দেয় না ওই আশ্রম।

তা হলে দেবযানী জল ও খাবার ছেড়ে যোগসাধনা করতেন কেন?

উত্তর পাচ্ছেন না তদন্তকারীরা। পুলিশি সূত্রের খবর, ওই আশ্রমের তরফে জানানো হয়েছে, তাঁরা কখনওই ৩০ সেকেন্ডের বেশি ধ্যান করা শেখান না। মন ও শরীর সুস্থ রাখতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মধ্যেই দিনে অন্তত ১৪ বার ৩০ সেকেন্ড করে ধ্যান করার কথা বলেন তাঁরা। খুব বেশি হলে এটা ১১২ বার করা সম্ভব। কিন্তু দেবযানী সেই পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাই নেননি। তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা, ওই আশ্রমে শেখা যোগসাধনাকে নিজের মতো করে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন দেবযানী। পরিণামে তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছিল। এমন যোগসাধনা তিনি কোথা থেকে শিখলেন, তা জানতে তাঁর ভাই, আপাতত পাভলভ মানসিক হাসপাতালের বাসিন্দা পার্থের সঙ্গেও কথা বলতে চান তদন্তকারীরা।

গত ১০ জুন শেক্সপিয়র সরণি থানা এলাকার ৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে দেবযানীর বাবা অরবিন্দবাবুর অগ্নিদগ্ধ দেহ উদ্ধার করা হয়। পরের দিন ওই বাড়িতেই পাওয়া যায় এক মহিলার কঙ্কাল। এখনও পর্যন্ত কঙ্কালটি দেবযানীর বলেই মনে করছে পুলিশ। পরে ওই মহিলার ডায়েরি ঘেঁটে এবং পার্থকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জেনেছে, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ক্রিয়াযোগ নামে একটি যোগসাধনা শুরু করেন দেবযানী। খাওয়াদাওয়া আর জলপান ছেড়ে দেন। তার জেরে ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ২৪ ডিসেম্বর থেকে সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেন। ২৯ ডিসেম্বর তিনি মারা যান বলে পার্থ পুলিশকে জানান।

যোগসাধনায় ওই মহিলা কত দূর এগিয়েছিলেন, সেটা জানতেই সম্প্রতি আশ্রমে যান তদন্তকারীরা। তাঁরা জেনেছেন, ’৯৭ সালে দেবযানী প্রথম ওই আশ্রমে যান ও সেখানকার সদস্য হন। সেখানে তিনি প্রাচীন যোগসাধনা পদ্ধতি (যোগক্রিয়া) শেখেন। তবে প্রথম ধাপের পরে দেবযানী আর ওই আশ্রমের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেননি বলে পুলিশের দাবি।

আশ্রম-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জেনেছে, দেবযানীর বাবা অরবিন্দবাবু এবং ভাই পার্থও ওই প্রাচীন সাধন-পদ্ধতি শেখার জন্য আশ্রমে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কোনও দিনই সেখানে যাননি। দেবযানী মাঝেমধ্যে যেতেন। শেষ যান ২০০১-এ। কিন্তু দেবযানীকে চেনেন, এমন কোনও প্রত্যক্ষদর্শীকে ওই আশ্রমে খুঁজে পাননি গোয়েন্দারা।

পুলিশ সূত্রের খবর, দেবযানীর যোগসাধনা আর রহস্যময় মৃত্যুর টানাপড়েনের মধ্যেই তাঁর ভাই পার্থ পাভলভের চিকিৎসকদের কাছে জানিয়েছেন, তাঁর বাবার শেষকৃত্যের আগে যেন দক্ষিণেশ্বরের ওই আশ্রম-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। অরবিন্দবাবুর দেহ এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গে রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE