Advertisement
০২ মে ২০২৪

চাকরি নেই, লরির নীচে ঝাঁপ যুবকের

বালিখাল থেকে নিমতলার দিকে পরপর ছুটে যাচ্ছে মালবাহী লরি। ঠিক তখনই জিটি রোডের ধারে একটি বাড়ির একতলা থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন এক যুবক। পরনে হাফ হাতা গেঞ্জি ও হাফ প্যান্ট। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি চলন্ত লরির নীচে ঝাঁপ দিলেন।

ভবানীশঙ্কর পাল

ভবানীশঙ্কর পাল

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৭ ০০:৫৫
Share: Save:

রাত প্রায় সাড়ে ১২টা। বালিখাল থেকে নিমতলার দিকে পরপর ছুটে যাচ্ছে মালবাহী লরি। ঠিক তখনই জিটি রোডের ধারে একটি বাড়ির একতলা থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন এক যুবক। পরনে হাফ হাতা গেঞ্জি ও হাফ প্যান্ট। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি চলন্ত লরির নীচে ঝাঁপ দিলেন। পিছনের চাকায় পিষে গেল তাঁর মাথা ও শরীর!

রাস্তায় লাগানো সিসি ক্যামেরায় বৃহস্পতিবার রাতের ভয়াবহ ওই ফুটেজ দেখে শিউরে উঠেছিলেন হাওড়ার পুলিশকর্তারা। জানা গিয়েছে, বালির পঞ্চাননতলার বাসিন্দা ওই যুবকের নাম ভবানীশঙ্কর পাল (২৪)। তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (ডিপ্লোমা)। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জেনেছে, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে সংস্থায় চাকরি পেয়েছিলেন, সেখানে তাঁকে দিয়ে কুলির কাজ করানো হতো। তাই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ায় চাকরি ছেড়ে চলে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু অভাবের সংসার কী ভাবে চালাবেন, তা নিয়ে প্রতিদিন অবসাদে ভুগতেন। তদন্তকারীদের ধারণা, সেই অবসাদ থেকেই ওই যুবক এ ভাবে আত্মঘাতী হয়েছেন।

গত বুধবারই সোনারপুরের বাসিন্দা অতনু মিস্ত্রি ইংরেজিতে এমএ পাশ করেও বেসরকারি সংস্থায় ঘর মোছার চাকরি পাওয়ায় অবসাদে আত্মহত্যা করেছিলেন। বছরখানেক আগেই এক সমীক্ষা-রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল, এ দেশে অন্তত ৪৫ হাজার আত্মহত্যার ঘটনার অন্যতম একটি কারণ বেকারত্ব। বালির এই ঘটনা ফের প্রমাণ করে দিল, পরিস্থিতি কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

স্থানীয় সূত্রের খবর, খুব ছোট বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পরে মা ভারতীদেবীর সঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর থেকে বালিতে মামার বাড়ি চলে আসেন ভবানীশঙ্কর। ছোট থেকেই মেধাবী ছাত্র। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে পদার্থবিদ্যা নিয়ে ভর্তি হন কলেজে। কিন্তু আট মাস ধরে গৃহশিক্ষকের বেতন বাকি পড়ায় পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়া ছেড়ে দেন। এর পরে বেলুড় মঠ পলিটেকনিক কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করে টাটানগরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজে যোগ দেন।

এ দিন তাঁর মা ভারতীদেবী বলেন, ‘‘ওখানে ওর যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ বা বেতন কোনওটিই দেওয়া হতো না। ঘর পরিষ্কার, নর্দমা সাফাই-সহ কুলির কাজ করাত।’’ তিনি জানান, ছেলে ভাল করে খেতে পায় না শুনে এক বার টাটানগরে থাকতে গিয়েছিলেন। তখনই ভবানীশঙ্কর তাঁর মাকে জানিয়েছিলেন, ওই সব কাজ করতে না চাইলে তাঁকে নিয়ে সবাই হাসিঠাট্টা করে। মানসিক অত্যাচার চালায়।

শেষে জানুয়ারিতেই চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন ওই যুবক। মনমরা হয়ে থাকতেন। রাস্তার ধারে মামার লেদ কারখানাতেই থাকতেন। এ দিন কান্নায় ভেঙে প়ড়ে ভারতীদেবী বলেন, ‘‘আমাকে প্রশ্ন করত, ‘মা, আমি কি চাকরি পাব না? আমাদের তা হলে কী হবে? তোমাকে কে দেখবে?’ এই সব বলত আর মাঝেমধ্যেই রাতে বাড়ির সামনে জিটি রোডে পায়চারি করত।’’ ওই রাতেও জিটি রোডে পায়চারি করতে বেরোন ওই যুবক।

ভবানীশঙ্কর বাইরে বেরোনোর পরেই মুহূর্তের মধ্যে কিছু পিষে যাওয়ার শব্দ পেয়ে ছুটে আসেন তাঁর মা ও মামা ব্রজনাথ দাস। তাঁরা দেখেন, একটি লরির চাকায় জড়িয়ে গিয়েছেন ওই যুবক। লরিটি টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে। ব্রজনাথবাবু জানান, তাঁদের চিৎকারেই লরিটি থেমে যায়। তত ক্ষণে চাকায় পিষে গিয়েছে যুবকের মাথা ও শরীর। প্রতিবেশী অতুল চন্দ্র বলেন, ‘‘খুব ভাল ছেলে। এত মেধাবী। কেন যে এমন করল!’’

এ দিন ভারতীদেবীর আক্ষেপ, ‘‘রোজ রাতেই বাইরে গেলে বলতাম, শুতে চলে আয়। চলেও আসত। কিন্তু কাল আর এল না।’’

এ ভাবে আত্মহত্যার পিছনে কোন ধরনের মানসিকতা কাজ করে?

মনোবিদ প্রদীপ সাহা বলেন, ‘‘কেউ বাবা কিংবা মাকে শিশুকালে হারালে ভবিষ্যতে তার একটা মানসিক সমস্যার সম্ভাবনা থাকে। ওই যুবক ইঞ্জিনিয়ারিং করেও কাজের জায়গায় আশাহত হয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। বুঝতে পারেন, কোনও পথ খোলা নেই। তখন সমাজের উপরে একটা প্রবল রাগ জন্মাল। তা থেকেই তৈরি হল নিজেকে সব কিছু থেকে সরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Depression Job Suicide Bali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE