দুর্যোগের শিকার। মঙ্গলবার, ক্যামাক স্ট্রিটে। নিজস্ব চিত্র।
ভরদুপুরে আচমকা অন্ধকার।
অথচ, মাত্র আধ ঘণ্টা আগেও দিব্যি খটখটে রোদে ঝলসে যাচ্ছিল চারপাশ। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘে যেন অসময়ে সন্ধ্যা। তার পরেই ঝড়। দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল টিনের চাল। মড়মড় করে গাছের ডাল ভেঙে পড়ল গাড়ির উপরে। ছিঁড়ে পড়ল বিদ্যুতের ওভারহেড তার। শহিদ মিনার ময়দানে কংগ্রেসের সভামঞ্চের ত্রিপল খুলে ঝুলতে লাগল। পথের হদিস পেতে তখন ভরসা স্রেফ গাড়ির হেডলাইট। পুরো এক মিনিটও নয়। ঝড় থেমে নামল প্রবল বৃষ্টি। অঝোর ধারায় তপ্ত শহরটাকে ধুয়ে দিয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যেই ফের ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। সঙ্গী শেষ বিকেলের আলো। তার মধ্যেই অবশ্য লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে কলকাতা।
কালবৈশাখী। মঙ্গলবারের ঝড়বৃষ্টির ধরনধারণ দেখে অন্তত তেমনটাই ভেবে ফেলেছিলেন সকলে। কিন্তু বাদ সেধেছে আবহাওয়া দফতর। হোক না ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার, তবুও এ দিনের ঝড়কে কালবৈশাখী বলতে নারাজ হাওয়া অফিসের কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, ঝড়ের গতিবেগ কালবৈশাখীর নিয়ম মানলেও, তার স্থায়িত্ব নিয়ম মানেনি। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুল দেবনাথ মঙ্গলবার বলেন, “কালবৈশাখী ঝড়ের স্থায়িত্ব হয় কম করে এক মিনিট। কিন্তু আজ কলকাতায় ঝড়ের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৩৮ সেকেন্ড। তাই আমরা একে কালবৈশাখী বলছি না। এটাকে বড়জোর দমকা হাওয়া বলা চলে।” অর্থাৎ, এ বছর এখনও পর্যন্ত কলকাতায় কালবৈশাখী এল না।
কলকাতার আশপাশের জেলাগুলি শনি থেকে সোমবারের মধ্যে মরসুমের প্রথম কালবৈশাখী পেয়েছে। কিন্তু কলকাতা এখনও পায়নি। এ দিনও মহানগরীতে কালবৈশাখীর পূর্বাভাস ছিল না। তবুও বিকেল তিনটে থেকে যে ভাবে আকাশ কালো হয়ে আসছিল, তাতে কালবৈশাখীর আমেজ ছিল। তবে আলিপুর আবহাওয়া অফিসের আবহবিদেরা বলে যাচ্ছিলেন, কালবৈশাখীর জন্য ঝাড়খণ্ডে তাপমাত্রা যে ভাবে বাড়ার কথা তা বাড়েনি। তা ছাড়া, কলকাতার উপরে যে বায়ুপ্রবাহ রয়েছে, তা-ও কালবৈশাখীর অনুকূল নয়।
পাশাপাশি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। মঙ্গলবার বাগবাজারে শুভাশিস ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
সাধারণত কালবৈশাখীর ক্ষেত্রে ঝাড়খণ্ডে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। গরম বাতাস উপরে উঠতে থাকে, তার জায়গা নেয় সমুদ্রের বাতাস। গরম বাতাস উপরে উঠে ঠান্ডা বাতাসে মিশে তৈরি করে উল্লম্ব মেঘ। জলীয় বাতাস ঢুকে তার উচ্চতা বাড়তে বাড়তে এক সময়ে আর জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে পারে না। সেই মেঘপুঞ্জ যেখানে ভাঙে সেখানেই হয় কালবৈশাখী। বাতাসের বেগ থাকে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের বেশি।
আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, আলিপুর আবহাওয়া অফিসের রেডারে এ দিন দুপুরের পরেই কলকাতা থেকে কিছুটা দূরে দু’টি উল্লম্ব মেঘপুঞ্জ ধরা পড়ে। কিন্তু তার কোনওটিরই উচ্চতা খুব বেশি ছিল না। বিকেল হতেই দু’টি মেঘপুঞ্জ কলকাতার আকাশে খুব কাছাকাছি চলে আসে। মহানগরীতে অকাল অন্ধকার নামে সাড়ে তিনটেতেই। তবে ওই দুই মেঘপুঞ্জ মিশে যে এমন কাণ্ড ঘটাবে, তার পূর্বাভাস ছিল না। তখনও হাওয়া অফিস জানাচ্ছিল, কালবৈশাখীর সম্ভাবনা নেই। বড়জোর বৃষ্টি হতে পারে শহরে।
পৌনে চারটে নাগাদ হুড়মুড় করে ঝড়, সঙ্গে বৃষ্টি। কোনওটাই অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কালবৈশাখী না হলে এমনটা হল কী করে? গোকুলবাবুর কথায়, “এটা একটা বিশেষ পরিস্থিতি। দু’টি মেঘপুঞ্জ একে অপরের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। মেঘপুঞ্জের উচ্চতা বেড়ে সম্মিলিত মেঘপুঞ্জ ভেঙে গিয়েই ঝোড়ো হাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে।”
জেলাগুলিতে কালবৈশাখী হওয়ায় গত তিন দিন ধরেই মহানগরীতে তাপমাত্রা তেমন বাড়ছে না। এ দিনের এক পশলা প্রবল বৃষ্টি তাপমাত্রা আরও কমিয়ে দিয়েছে। আজ, বুধবারও কলকাতায় মেঘলা আকাশ ও ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর।
এ দিকে, অল্পক্ষণের ঝড়-বৃষ্টিতেই এ দিন শহরে বেশ কিছু গাছ পড়েছে, জল জমেছে বিভিন্ন এলাকায়। বৃষ্টি তাড়াতাড়ি থেমে যাওয়ায় অবশ্য জল নেমেও গিয়েছে দ্রুত। মেয়র পারিষদ (পার্ক ও উদ্যান) দেবাশিস কুমার জানান, দক্ষিণ কলকাতার শরৎ বসু রোড, ক্যামাক স্ট্রিট, আনোয়ার শাহ রোড, যাদবপুর এবং উত্তর কলকাতার বাগবাজার এলাকায় কয়েকটি গাছ ভেঙে পড়ে। পুরসভার র্যাপিড অ্যাকশন বাহিনীর কর্মীরা দ্রুত গিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করেন। ক্যামাক স্ট্রিটে ভেঙে পড়ে তিনটি বাতিস্তম্ভও।
এ দিনের ঝড়ে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন এলাকার প্রায় ৩০টি পোল পড়ে যায়। তার ফলে বিদ্যুৎ পরিষেবা সব থেকে বেশি ব্যাহত হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই পরিষেবা স্বাভাবিক করার কাজ চলছে জানায় সংস্থা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy