Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘নিরীহ’ সুরজিতের ঠান্ডা নৃশংসতায় হতবাক পড়শিরাও

চেনা পরিচিতেরা সবাই তাঁকে অত্যন্ত নিরীহ, গোবেচারা প্রকৃতির মানুষ বলেই জানেন। এ হেন সুরজিৎ দেব যে নিজের স্ত্রীকে মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলে এসেছিলেন, তা এখনও ভাবতে পারছেন না কেউই।

লিপিকা ও সুরজিৎ

লিপিকা ও সুরজিৎ

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৪ ০০:০৭
Share: Save:

চেনা পরিচিতেরা সবাই তাঁকে অত্যন্ত নিরীহ, গোবেচারা প্রকৃতির মানুষ বলেই জানেন। এ হেন সুরজিৎ দেব যে নিজের স্ত্রীকে মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলে এসেছিলেন, তা এখনও ভাবতে পারছেন না কেউই।

গত ২০ মে শিয়ালদহ স্টেশনের পার্কিং লটে পড়ে থাকা একটি হোল্ড-অল এবং একটি ট্রলির মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল মাঝবয়সী এক মহিলার ছ’টুকরো দেহ। তদন্তকারীরা ট্রলি ব্যাগটি কেনার রসিদ পেয়েছিলেন ব্যাগের ভিতরেই। সেই রসিদের ঠিকানার সূত্র ধরে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, মৃতার নাম জয়ন্তী দেব। বাড়ি লেকটাউনে। পরে পুলিশ মৃতার স্বামী সুরজিৎ, তাঁর বান্ধবী লিপিকা পোদ্দার এবং তাঁর পরিচিত সঞ্জয় বিশ্বাসকে গ্রেফতার করে। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, সুরজিৎ ও লিপিকা মিলে খুন করে জয়ন্তীকে। পরে তারা দেহটি সরানোর জন্য সঞ্জয়কে ডাকে। সঞ্জয় মৃতদেহটি টুকরো টুকরো করে ট্রলি ও হোল্ড-অলে ঢোকায়। পরে সবাই মিলে ট্যাক্সি ভাড়া করে সেগুলি শিয়ালদহে পার্কিং লটে রেখে আসে।

কিন্তু নিরীহ প্রকৃতির সুরজিৎ এ ধরনের কাজ করল কী করে? উত্তর জানতে গিয়ে বিস্মিত তদন্তকারীরাও। সুরজিতের পড়শি রাজু কুণ্ডু জানান, দশ বছর আগে সুরজিৎ স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে এসেছিল। একটি নামী বেসরকারি সংস্থার কর্মী সুরজিৎ ব্যাঙ্ক-ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাটটি কেনে। পড়শিরা জানান, জয়ন্তীর সঙ্গে সুরজিতের সম্পর্ক ভাল ছিল না। মাঝেমধ্যেই অশান্তি চরমে উঠত। হাতাহাতিও হত। বিবাদের সময়ে জয়ন্তীর গলার আওয়াজই বেশি পাওয়া যেত বলে পাড়ার লোকের দাবি। পড়শিরা জানান, অফিস থেকে ফেরার পরে সুরজিতকে মাঝেমাঝেই ফ্ল্যাটে ঢুকতে দিতেন না জয়ন্তী। তখন সুরজিৎ বিরাটিতে তার মায়ের কাছে চলে যেত।

জয়ন্তী

শুধু সুরজিৎই নয়, জয়ন্তীর সঙ্গে রোজই গোলমাল হত তাঁর ১৯ বছরের মেয়েরও। মেয়েও মাকে ছেড়ে থাকতে শুরু করে তার জ্যাঠার কাছে। তদন্তকারীদের সুরজিৎ জানিয়েছে, স্ত্রীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সে বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে বিরাটি চলে যায়। সেখানেই বৃদ্ধা মায়ের আয়া লিপিকার সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু এর পরেও সে জয়ন্তীকে নিয়েই সংসার করতে চেয়েছিল বলে সুরজিৎ তদন্তকারীদের জানায়। রেল পুলিশের দাবি, জেরায় সুরজিৎ জানায়, কয়েক বছর ধরে তাদের বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছিল। চলতি মাসের গোড়ায় বিচারক তাকে ও জয়ন্তীকে মিলেমিশে থাকার নির্দেশ দেন। সুরজিৎ সেই মতো ফিরে আসে লেকটাউনে। মেয়েকেও নিয়ে আসে দাদার বাড়ি থেকে।

পুলিশের দাবি, জেরায় সুরজিৎ জানায়, এর কয়েক দিন পর থেকে ফের জয়ন্তীর সঙ্গে তার ও মেয়ের গোলমাল শুরু হয়। ১৯ মে রাতে জয়ন্তীর সঙ্গে মেয়ের ঝগড়া চরমে ওঠে। তার জেরে রাতে মেয়ে বাইরের ঘরে শুয়ে পড়ে। সুরজিৎ পুলিশকে জানিয়েছে, মেয়ের উপরে এই অত্যাচার দেখে সে আর মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। পুলিশের দাবি, তদন্তকারীদের সুরজিৎ জানিয়েছে, সারা রাত সে ঘুমোতে পারেনি। খুব ভোরে সে ঘুমন্ত স্ত্রীর মাথায় পিলসুজের বাড়ি মারেন। সুরজিতের দাবি, ওই আঘাতে জয়ন্তী মরেননি। তাঁর চিৎকার শুনে মেয়ে পাশের ঘর থেকে চলে আসে। ওই সময়ে তিনি মেয়েকে বলেন, জয়ন্তী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মেয়েকে ৫০ টাকা দিয়ে জ্যাঠার বাড়িতে চলে যেতে বলে সে। মেয়ে ওই টাকা নিয়ে চলে যায় বলে সুরজিৎ পুলিশকে জানিয়েছে। তদন্তকারীদের সে জানায়, এর পরে সে ফোন করে লিপিকাকে ডাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে বিরাটি থেকে লিপিকা আসে লেকটাউনে। সুরজিৎ পুলিশকে জানায়, লিপিকাই বালিশ চাপা দিয়ে জয়ন্তীকে খুন করে। এর পরে লিপিকা পরিচিত সঞ্জয়কে ডাকে লাশ পাচারের জন্য।

তদন্তকারীরা জানান, আলিবাবার গল্পের বাবা মুস্তাফার মতো সঞ্জয় বিশ্বাস নামের একটি চরিত্র এর পরে ঢুকে পড়ে এই কাহিনিতে। বাবা মুস্তাফা টাকা নিয়ে কাটা লাশ জোড়া দিয়েছিলেন। এখানে সঞ্জয় লাশ টুকরো টুকরো করে পাচার করার কাজে নিযুক্ত হয়। পুলিশ জানায়, সঞ্জয়ের বাড়ি রানাঘাটে। লিপিকার বাড়িও সেখানে। সেই সূত্রেই সঞ্জয়ের সঙ্গে তার আলাপ। লিপিকাকে জেরায় পুলিশ জেনেছে, সঞ্জয় লিপিকাকে বলেছিল, টাকার জন্য সে খুনও করতে পারে। সেই কথার সূত্রেই সঞ্জয়ের কথা মাথায় আসে লিপিকার। লাশ পাচারের জন্য সঞ্জয়কে ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলে সে। সেই মতো ধারালো অস্ত্র এনে লাশ কেটে ট্রলি ও হোল্ড-অলে ভরে সঞ্জয়। গ্রেফতারির পরে সঞ্জয় পুলিশকে জানিয়েছে, ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তাকে দেওয়া হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।

তদন্তকারীদের ধারণা, দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়িত সুরজিৎ ঘটনার দিন মেয়ের উপর অত্যাচার দেখেই রাগের মাথায় জয়ন্তীর উপরে পাল্টা হামলা চালায়। এক জন নিরীহ প্রকৃতির মানুষ কী করে স্ত্রীকে মেরে ঠান্ডা মাথায় লোক ডেকে টুকরো টুকরো করে ফেলে এল? মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল জানান, দীর্ঘদিন ধরে কেউ অত্যাচারিত হলে, তাঁর মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বা অভিমান কাজ করে। অনেক সময়ে তিনি বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। সেখান থেকেই এ ধরনের হিংস্রতা আসতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

muder surajit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE