Advertisement
০১ মে ২০২৪

পরপর ন’টি গাড়িতে ধাক্কা মারল চালকবিহীন ট্রাম

সকাল সাড়ে ন’টার ভরা অফিসটাইম। আচমকাই পথচলতি মানুষ খেয়াল করলেন ব্যস্ত রাস্তার মাঝখান দিয়ে ছুটছে ফাঁকা ট্রাম। সিগন্যাল ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে বেপরোয়া ভাবে। ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে সিগন্যালে দাঁড়ানো একের পর এক গাড়িকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থাটা কাটতেই ফুটপাথবাসী দুই যুবক খেয়াল করলেন, ট্রামে চালক নেই।

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৪ ০০:১৮
Share: Save:

সকাল সাড়ে ন’টার ভরা অফিসটাইম। আচমকাই পথচলতি মানুষ খেয়াল করলেন ব্যস্ত রাস্তার মাঝখান দিয়ে ছুটছে ফাঁকা ট্রাম। সিগন্যাল ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে বেপরোয়া ভাবে। ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে সিগন্যালে দাঁড়ানো একের পর এক গাড়িকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থাটা কাটতেই ফুটপাথবাসী দুই যুবক খেয়াল করলেন, ট্রামে চালক নেই। বিপদের গুরুত্ব বুঝে এর পর ছুট ট্রামের পিছন-পিছন। প্রাণ বাজি রেখে এক জন উঠে পড়লেন চলন্ত ট্রামে। ব্রেক কোনটা জানা নেই। অগত্যা আন্দাজেই একটা হাতল ধরে টান। থামল ট্রাম। সঙ্গে গলগল করে ধোঁয়া। ততক্ষণ অন্য যুবক পাশে পাশে ছুটেছেন। অন্য গাড়িগুলোকে সমানেই হাত দেখিয়ে বলেছেন পাশে সরে যেতে।

সরিয়ে দিয়েছেন রাস্তা পেরোতে যাওয়া মানুষকে। এড়ানো গিয়েছে বড়সড় বিপদ।

বৃহস্পতিবার বালিগঞ্জ ফাঁড়ির ব্যস্ত মোড়ে ঝিরঝির বৃষ্টির সকালে বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে চলা এমন ঘটনায় কার্যত হতবাক হয়ে পড়েন পথচারী, রাস্তার অন্যান্য গাড়ির চালক, যাত্রী, স্থানীয় দোকানদার ও বাসিন্দারা। এই ঘটনার জেরে তুমুল যানজট হয় প্রায় পার্ক সার্কাস মোড় পর্যন্ত। পুলিশ জানায়, এ দিন ওই ট্রামটির ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় মোট ন’টি গাড়ি। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, ট্রাম ধীরগতির যান হওয়ায় গাড়িগুলোর সামনে-পিছনে দুমড়েমুচড়ে গেলেও আরোহীরা অক্ষতই ছিলেন। কারও কারও অল্পস্বল্প আঘাত লাগে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ব্যস্ত রাস্তায় কোনও না কোনও দুর্ঘটনা রোজই ঘটে। কিন্তু এমন ঘটনা তাঁরা এর আগে কোনও দিন দেখেননি।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, যাঁদের উপস্থিত বুদ্ধিতে বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা মেলে, সেই দুই যুবকের নাম দীনেশ লাল এবং জগ্গু কাপাডিয়া। তাঁরা বালিগঞ্জের ওই ফুটপাথেই থাকেন। ওই সময়ে ফুটপাথেরই একটি দোকানে খাচ্ছিলেন তাঁরা। তখনই পুরো ঘটনাটা দেখে বিপদ আঁচ করে ছুটে যান। ট্রামটির থামার পরে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করলে দমকলের একটি ইঞ্জিন গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের গড়িয়াহাট শাখার উচ্চপদস্থ কর্তা ঢাকুরিয়ার বাসিন্দা রথীন চক্রবর্তী রোজ এই পথেই নিজের গাড়িতে কর্মস্থলে যান। তিনি বলেন, “গড়িয়াহাট উড়ালপুল থেকে নামার পরে দেখি ট্রামডিপোর কাছে প্রায় অর্ধেক রাস্তা জুড়ে একটি ট্রাম বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা পাশ কাটিয়ে চলে যাই। ট্রামটা পুরোটাই ফাঁকা ছিল। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির মোড়ে হঠাৎই দেখি গাড়ির পিছনে একটা ট্রাম আসছে। আর দুটো ছেলে দৌড়তে দৌড়তে বলছে, ‘সরে যান, সরে যান।’ কিন্তু সরার আগেই গাড়ির পিছনে ধাক্কার আওয়াজ। পিঠে জোর কাঁপুনি। ওই ছেলে দুটো চিৎকার না করলে কিন্তু আমরা অনেকেই পিষে যেতাম। ওদের জন্যই বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছি।”

রথীনবাবুর গাড়ির চালক হরেন হালদার বলেন “ছেলে দুটোর চিৎকার শুনে আর ঘাড় ঘুড়িয়ে ট্রামটাকে দেখেই গাড়িটাকে সরানোর চেষ্টা করি। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রামটা গাড়ির পিছনে ধাক্কা দিয়ে দিল।”

ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িগুলির মালিকেরা ট্রামের চালক এবং ট্রাম কোম্পানির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগ দায়ের করেছেন। ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, ট্রামটির নম্বর ৫১৬। রাজাবাজার-গড়িয়াহাট রুটের ওই ট্রামটি গড়িয়াহাট ডিপো থেকে বেরোনোর পরেই সেটিতে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। তবে রাস্তায় ট্রামটিকে ফেলে চালক কোথায় গিয়েছিলেন, তা নিয়েও পুলিশ খোঁজ নিতে শুরু করেছে। তদন্তকারীদের অনুমান, চালক ট্রাম থেকে নেমে যাওয়ার সময়ে ব্রেক বন্ধ না করেই নেমে গিয়ছিলেন। তার জেরেই এই বিপত্তি।

উদাসীনতার অভিযোগ ওঠায় এ দিনই ঘটনার তদন্ত শুরু করেন সিটিসি কর্তৃপক্ষ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধর্মতলায় সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয় অভিযুক্ত ট্রামচালক এবং গড়িয়াহাট ডিপোর ভারপ্রাপ্ত আধিকারিককে। প্রাথমিক তদন্তের পরে কর্তৃপক্ষ জেনেছেন, অভিযুক্ত চালক দাবি করেছেন ট্রামটির ‘রেজিস্ট্যান্স বক্সে’ যান্ত্রিক গোলযোগ ছিল। ট্রামটি ডিপো থেকে বেরিয়ে আবার ডিপোতেই ঢুকছিল। কিন্তু ডিপো থেকে বেরিয়েই যান্ত্রিক গোলযোগে ট্রাম থেমে যায়।

সংস্থা সূত্রে খবর, চালক উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে স্বীকার করেছেন, তিনি ব্রেক বন্ধ না করেই ট্রামের গোলযোগ দেখতে নেমে পড়েন। এর পরে আচমকাই ট্রামটি সোজা চলতে শুরু করেন।

সংস্থার এক কর্তা বলেন, “চালকের এই কাজকে আমরা চরম গাফিলতি বলে চিহ্নিত করেছি।

তাঁকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছে।” পুলিশের তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, ট্রামের বিদ্যুৎসংযোগ চলে যাওয়ায় ট্রামটি থেমে গিয়েছিল। ব্রেক বন্ধ না থাকায় বিদ্যুৎ ফিরতেই ট্রামের চাকা গড়াতে শুরু করে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেন, ঘটনার সময়ে কোনও ট্রাফিক কর্মী বা সার্জেন্টকে রাস্তায় দেখা যায়নি। অনেক পরে তারা ঘটনাস্থলে আসেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ট্রাফিক পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলেন, “বালিগঞ্জ ফাঁড়ির মোড়ে সব সময়েই ট্রাফিক পুলিশ থাকে। তবু অভিযোগ যখন উঠেছে, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব।”

পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্তা জানিয়েছেন, এ দিনের ঘটনার প্রাথমিক তদন্তের পরে জানা গিয়েছে, দীনেশই চলন্ত ট্রামটিতে উঠে গিয়ে সেটিকে থামান।

দুই যুবককেই এ দিন সন্ধ্যায় গড়িয়াহাট থানায় ডেকে পাঠান কলকাতা পুলিশের ডিসি (এসইডি) গৌরব শর্মা। সবিস্তার পুরো বিষয়টি জানার পাশাপাশি ওই দুই যুবকের সাহসিকতার জন্য ধন্যবাদও জানিয়েছেন তিনি। লালবাজারের এক পুলিশকর্তা জানিয়েছেন, ওই দুই যুবকের জন্যই বড়সড় দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়েছে এ দিন। তাঁদের সাহসিকতার পুরস্কার দেওয়ার জন্য নাম সুপারিশ করা হচ্ছে।

আন্দাজে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দেখি, ট্রামটা থেমে গেল

দেবাশিস দাস

দীনেশ লাল ও (ডান দিকে) জগ্গু কাপাডিয়া। —নিজস্ব চিত্র।

ফুটপাথেই বেড়ে উঠেছেন দীনেশ লাল ও জগ্গু কাপাডিয়া। ওঁদেরই উপস্থিত বুদ্ধিতে বৃহস্পতিবার বড়সড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বহু গাড়ি ও পথচলতি মানুষ। হতবাক হয়ে তা দেখেছে অফিসটাইমের বালিগঞ্জ ফাঁড়ি।

স্কুলে পড়েননি চব্বিশের দীনেশ বা বত্রিশের জগ্গু। স্থায়ী পেশাও নেই। এ দিনও বাসস্ট্যান্ডের দোকানে প্রাতরাশ সারছিলেন। হঠাৎই দেখেন, রাস্তার গাড়িকে ধাক্কা দিতে দিতে দুরন্ত গতিতে ছুটে আসছে ফাঁকা ট্রাম। খাবার ফেলে দুই বন্ধু ছুট দেন ট্রাম থামাতে। একটি স্কুলের সামনে থেকে ছুটতে ছুটতে প্রায় ধাবার সামনে গিয়ে ট্রামে উঠতে পারেন দীনেশ। তিনি বলেন, “চালকের জায়গায় গিয়ে ‘ব্রেক’ খুঁজতে থাকি। আন্দাজে একটা হ্যান্ডেল নাড়াতেই ট্রাম থেমে গেল।” জগ্গু জানান, দীনেশের চেষ্টায় ট্রামটা সময়মতো থেমে না গেলে অন্তত চার জন মহিলা ট্রামের তলায় চলে যেতেন। ওঁরা রাস্তা পেরোচ্ছিলেন।

পুলিশ জানায়, দীনেশ একটি সংস্থায় অস্থায়ী সাফাইকর্মীর কাজ করেন। বছরখানেক আগে বিয়ে করেছেন। তাঁর দুই বোন হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। বিধবা মা ও ৮ ভাই-বোনকে নিয়ে ফুটপাথেই সংসার জগ্গুর। নিজেরও তিন সন্তান। পুলিশ জানায়, জগ্গু মাঝেমধ্যে বাসের কন্ডাক্টরের কাজ করেন। দীনেশের মা বলেন, “ছেলে দুটো না থাকলে আজ একটা বড় অঘটন ঘটত। সরকার যেন ওদের এই কাজের একটা মূল্য দেয়।”

প্রাণ বাজি রেখে শহরকে বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচিয়ে খুশি দীনেশ-জগ্গুও। বললেন, “সকালে যখন ট্রামটা দেখে একসঙ্গে দৌড়লাম, তখনও জানি না আমরা কী করতে ছুটছি। বোধ হয় ঈশ্বরের আশীর্বাদেই এতগুলো লোককে বাঁচাতে পারলাম।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

accident debashis das driverless tram tram
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE