Advertisement
E-Paper

বিরোধীদের সুদীপ ফুঁয়ে ওড়ালেও উত্তর মেলাবে কে

শিয়রে ভোট। তায় চতুর্মুখী লড়াই ঘিরে চরম উত্তেজনা! তবু তিন নম্বর লোয়ার রডন স্ট্রিটের আস্তানায় খোশমেজাজেই আছেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের ‘ছোড়দা’! কেন এত চাপমুক্ত? ধীরে ধীরে জবাব দেন পোড়খাওয়া রাজনীতিক, “আমি মনে করি, কলকাতার ভোটারেরা রাজনৈতিক ভাবে সচেতন। প্রার্থীর চেয়ে তাঁর দলের কাজ বিচার করেই ভোট দেন।”

সঞ্জয় সিংহ

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৪ ০৩:২৩

শিয়রে ভোট। তায় চতুর্মুখী লড়াই ঘিরে চরম উত্তেজনা! তবু তিন নম্বর লোয়ার রডন স্ট্রিটের আস্তানায় খোশমেজাজেই আছেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের ‘ছোড়দা’!

কেন এত চাপমুক্ত? ধীরে ধীরে জবাব দেন পোড়খাওয়া রাজনীতিক, “আমি মনে করি, কলকাতার ভোটারেরা রাজনৈতিক ভাবে সচেতন। প্রার্থীর চেয়ে তাঁর দলের কাজ বিচার করেই ভোট দেন।”

বিদেশে পড়াশোনা করে আসা ছেলে রোহন তখন ল্যাপটপ নিয়ে ফেসবুক, টুইটারে পোস্ট করে চলেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন যুব কংগ্রেসের দুই সহকর্মী। তৃপ্ত পিতা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলেন, “ও এই প্রজন্মের ছেলে। ফেসবুক-ইন্টারনেটে ও আমার হয়ে প্রচারের কাজটা করে দিচ্ছে।” তাই কি নিশ্চিত? আবার হাসেন ছোড়দা। প্রচণ্ড গরমে, কড়া রোদে রোজ সকালে নিয়ম করে এ-পাড়া, ও-পাড়া ঘুরতে হয়েছে। কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৬০টি ওয়ার্ডেই চক্কর মারা শেষ। এখন শুধু বিকেল থেকে রাত এখানে-ওখানে রোড শো আর জনসভার কর্মসূচি।

সে জন্যই বুঝি হাল্কা মেজাজে?

নড়েচড়ে বসেন ছোড়দা। হাসতে হাসতে বলেন, “আমি রিল্যাক্সড্ অন্য কারণে। বছর ছয়েক আগে একটা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলাম। যন্ত্রণাটা ছিল অপমানের, অসম্মানের।” লিকার চায়ে একটা চুমুক দিয়ে ছোড়দা বলে চলেন, “সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে আমাকে প্রায়ই শুনতে হতো, সিপিএমের দালালি করছি! সে জন্যেই বাংলায় সিপিএমের অপশাসনের অবলুপ্তি হচ্ছে না।”

তাই যন্ত্রণা। ছোড়দার মনে হয়েছিল, বাংলার সিপিএম-বিরোধী সব শক্তি এক হওয়া দরকার। না হলে সিপিএম হটানো যাবে না। সেই কারণেই কংগ্রেস ছেড়ে প্রথমে প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস করেছিলেন। তার পর তৃণমূলে যোগদান।

কিন্তু যন্ত্রণার তো উপশম হল না! “তৃণমূলে গিয়ে দেখলাম, গোটা দলটাকেই হাইজ্যাক করেছে সিপিএম-হার্মাদদের একটা অংশ! তাদের ঝান্ডা বদল হলেও চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি।” ছোড়দা জানান, হাঁপিয়ে উঠেছিলেন তিনি। ফিরে এলেন কংগ্রেসে। পুরনো সহকর্মীদের নিয়ে কলকাতার উত্তর থেকে মধ্য, পূর্ব থেকে পশ্চিমে নেমে পড়লেন।

স্বস্তি পেলেন ‘ছোড়দা’ সোমেন মিত্র।

উত্তর কলকাতার যুদ্ধে এ বার ছোড়দাই তাঁর পুরনো দলের আশা-ভরসা। তাঁকে ঘিরেই এই কেন্দ্রে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন দিল্লি এবং রাজ্যের কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা।

উত্তর কলকাতার বিদায়ী সাংসদ তথা তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও তাঁর সব বিরোধীকেই একেবারে ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন। শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশের বক্তব্য, সোমেনবাবু তো একা! একদা যে মধ্য কলকাতায় তিনি রাজ করতেন, সেখানকার এক জন কাউন্সিলরও তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসে চলে যাননি। এমনকী সোমেনবাবুর স্ত্রী, তৃণমূলের ‘বিদ্রোহী’ বিধায়ক শিখা মিত্রকেও তাঁর সঙ্গে প্রচারে দেখা যাচ্ছে না। সোমেনবাবু অবশ্য যুক্তি দিচ্ছেন, “আমার স্ত্রীর অবস্থান কোথায়, সেটা ওঁর দল থেকে স্পষ্ট করে দিক আগে। তৃণমূল নেতারা মুখে বলছেন, ওঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু কোনও চিঠি তো দেননি! ফলে উনি কী ভাবে প্রচারে থাকবেন?”

অভিনেত্রী ও প্রাক্তন বিধায়ক, স্ত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে উল্টোডাঙা থেকে কাঁকুড়গাছির দিকে অন্তত এক ডজন ট্যাবলো-সহ বর্ণাঢ্য রোড শো করছিলেন সুদীপবাবু। হুডখোলা জিপে সস্ত্রীক সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত তৃণমূল প্রার্থী। চতুর্মুখী লড়াইয়ে কতটা নিশ্চিত? প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আত্মবিশ্বাসী, “গত বারের চেয়ে বেশি ভোটে জিতব!’’ কেন? সুদীপবাবুর ব্যাখ্যা, “আমি ইতিবাচক কথা বলে ভোট চাই। উত্তর কলকাতায় কোনও ব্যক্তি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নন। এখানে আরও দ্রুত কত উন্নয়ন করা যায়, সেই লক্ষ্যেই আমি লড়াই করি।” গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটের সংস্কার ও সৌন্দর্যায়ন-সহ ৩২৬টি উন্নয়নমূলক প্রকল্প গত পাঁচ বছরে তাঁর সাংসদ তহবিলের টাকায় বাস্তবায়িত হয়েছে বলে সুদীপবাবু জানাচ্ছেন।

গত বার কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের প্রার্থী সুদীপবাবু জিতেছিলেন ১ লক্ষ ৯ হাজার ২৭৮ ভোটে। এ বার জোট তো নেই-ই, মাঝে রয়েছেন সোমেনবাবুর মতো ওজনদার প্রতিপক্ষ। আছেন কলকাতা পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী সিপিএমের রূপা বাগচী, বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মতো জাঁদরেল প্রার্থীরা। প্রসঙ্গ শুনে রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের হাত নাড়তে নাড়তে সুদীপবাবুরই পাল্টা প্রশ্ন, “ধুস্, এঁরা আমার প্রতিপক্ষ?”

তিনি যা-ই বলুন, সমস্ত দলের অন্দরমহল থেকে শুরু করে উত্তর কলকাতার রকে-চায়ের দোকানে আড্ডা কিন্তু অন্য সম্ভাবনা আঁচ করছে। একে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট নেই। উল্টে বিজেপির পালে হাওয়া লেগেছে। স্বাভাবিক নিয়মেই তৃণমূলের ভোট তো গত বারের চেয়ে কমতে পারে। সুদীপবাবুর কাছে এ কথা পাড়তেই বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বা দেবীপ্রসাদ পালের মতো ব্যক্তিত্বদের কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল। ওঁরা ‘পুওর থার্ড’ হয়েছিলেন! ওঁদের যে হাল হয়েছিল, এ বার তা হবে সোমেনবাবুরও!” এককালীন সহকর্মীর মন্তব্য শুনে আবার হাসেন ছোড়দা। সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “সুদীপবাবুর নিজের কথাটা মনে রাখা দরকার! ২০০৪ সালে জোড়া মোমবাতি নিয়ে উনিও ‘পুওর থার্ড’ হয়েছিলেন!”

সে বার সুদীপবাবুর সঙ্গে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোমালিন্য এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, দল থেকে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। তখন সাবেক কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং সিপিএমের সুধাংশু শীলের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সমর্থনে সুদীপবাবু নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ভোট কাটাকাটির অঙ্কে সুব্রতবাবু হেরেছিলেন। জয়ী হয়েছিলেন সুধাংশুবাবু। এ বারও সেই ভোট কাটাকুটির অঙ্ক ফিরে এসেছে। সোমেনবাবু কত ভোট টানবেন, তা নিয়ে জল্পনা আছে যথেষ্টই।

সিপিএম কিন্তু গত বার পাওয়া ৪০% ভোট ধরে রাখা নিয়ে আশাবাদী। দলীয় প্রার্থী রূপা বাগচীর কথায়, “আমরা ভোট কাটাকাটির হিসেব কষছি না। এই কেন্দ্রে পুরসভার ৬০টি ওয়ার্ড ঘুরে মানুষের যা সাড়া পেয়েছি, তাতে আমরা আশাবাদী।” রূপার মতে, ৩৪ মাসে মানুষের অভিজ্ঞতা তিক্ত। তৃণমূল সরকারের ‘অরাজকতায়’ তাঁরা অতিষ্ঠ। সেই সঙ্গে রয়েছে মহিলাদের নিরাপত্তার অভাব। এটা যদি রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়, তা হলে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধিও মানুষের মনে প্রচণ্ড ছাপ ফেলেছে। রূপার মতে, এ সবেরই প্রতিবাদ জানাতেই মানুষ তাঁদের সমর্থন করবে।

সুদীপবাবু অবশ্য রূপাকে প্রার্থী হিসেবে একেবারেই নম্বর দিচ্ছেন না! রোড শো-র ফাঁকে তৃণমূল প্রার্থীর মন্তব্য, “সুধাংশুবাবু হলেও একটা কথা ছিল। রূপা তো মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রে আমাদের সাধন পাণ্ডের কাছেই ৩৬ হাজার ভোটে হেরেছে! কোনও হিসেবেই আসে না!” সাধনবাবু নিজেও মনে করিয়ে দিলেন বিধানসভা ভোটের ফল ধরলে বামেদের চেয়ে তৃণমূল এগিয়ে আড়াই লাখেরও বেশি ভোটে। সব শুনে রূপা শুধু বলছেন, “রাজনৈতিক লড়াইয়ে নেমে প্রতিপক্ষকে ছোট করে দেখা ভুল। আর ওঁর (সুদীপবাবু) জীবনে কি পরাজয় আসেনি? বাম জমানার ৩৪ বছরে ওঁদের অনেক নেতা-প্রার্থী ছিলেন, যাঁরা শুধু হেরেই চলতেন!” পরে ইসলামিয়া হাসপাতালের পাশে পথসভা করতে যাওয়ার আগে রূপা স্পষ্ট করে দিলেন, গত বিধানসভার ভোটের ফলাফল ধরতে তিনি নারাজ। কারণ, তার পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা। তখন রাজ্য জুড়ে পরিবর্তনের হাওয়া উঠেছিল।

আর রাহুল সিংহ?

সুদীপবাবু তাঁকেও ধর্তব্যের মধ্যে আনছেন না ঠিকই, কিন্তু উত্তর কলকাতার আনাচে-কানাচে কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও রোড শো করে, আবার কখনও পথসভা করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন বিজেপি প্রার্থী। সেই সঙ্গে মোদী-হাওয়া শনশন! উত্তর কলকাতার অবাঙালি বলয়ে কান পাতলে সে শব্দ শোনাও যাচ্ছে! এই কেন্দ্রের ৫৮% অবাঙালি বাসিন্দাদের ভোটের সিংহভাগই তিনি পাবেন বলে রাহুলবাবু দাবি করছেন। তিনি জানাচ্ছেন, অবাঙালিদের বিভিন্ন সংগঠন, অন্তত ৮০টি আবাসনের অবাঙালি বাসিন্দারা সংবর্ধনা দিয়েছেন তাঁকে। আবার সুদীপবাবুর পাল্টা দাবি, অবাঙালি ভোটারেরা রাহুলবাবু নন, আসলে তাঁকেই হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছেন। কারণ তাঁরা জানেন, তিন বারের সাংসদ কী কী কাজ করেছেন! তবু রাহুল কিন্তু চরম আত্মবিশ্বাসী। বলছেন, “আগে এক বার চুপচাপ ফুলে ছাপ দিতে বলেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। এ বার গুরু মারা বিদ্যা দেখবেন! চুপচাপ পদ্মে ছাপ পড়বে!”

চুপচাপ-এর এই হাওয়াটাই এ বার জিইয়ে রাখল অনিশ্চয়তা।

tapas sinha vote in calcutta north
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy