আগামী বছরেই কলকাতা পুরসভার নির্বাচন। তাই কলকাতার কোনও এলাকাকেই আর জলসঙ্কটে পড়তে দিতে রাজি নন পুর-কর্তৃপক্ষ। সেই লক্ষ্যেই নিজেদের নীতি থেকে সরে গিয়ে শহরের অন্তত ১৬টি ওয়ার্ডে গভীর নলকূপ বসানোর সিদ্ধান্ত নিল কলকাতা পুরসভা। বরো চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠকে বসে সোমবার ওই ১৬টি ওয়ার্ডে শতাধিক গভীর নলকূপ বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়।
শহরের জলস্তর হু হু করে নেমে যাওয়ায় মহানগরীতে গভীর নলকূপ নিয়ন্ত্রণ করার কথা ঘোষণা করেছিল কলকাতা পুরসভা। জলস্তর নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের বিভিন্ন এলাকায় গভীর নলকূপ ভূগর্ভ থেকে তুলে আনছিল বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক। আর্সেনিকের দাপট রুখতে পুরসভা গভীর নলকূপ খননের উপরে নিয়ন্ত্রণ জারি করে জানিয়ে দিয়েছিল, বিকল্প জলের উৎস না দেখালে বহুতলগুলিকে গভীর নলকূপ ব্যবহারের অনুমতিও দেওয়া হবে না। পুরসভার নিজস্ব নলকূপগুলিকেও তুলে ফেলা হচ্ছিল বিভিন্ন এলাকায়। কলকাতার ১৪১টি ওয়ার্ডে গঙ্গার পরিশোধিত জল পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছে দিয়ে শহর থেকে নিজেদের সব গভীর নলকূপ তুলে ফেলার পরিকল্পনাও নিয়েছিল পুরসভা। কিন্তু সব ওয়ার্ডে গঙ্গার পরিশোধিত জল পৌঁছে দিতে না পারায় শেষ পর্যন্ত নিজেদের নীতির বিরুদ্ধেই হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরসভা।
এই ভাবে গভীর নলকূপ বসানোর উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিলে বিভিন্ন বহুতল বাড়িকে আর নলকূপ বসানো থেকে কি বিরত করতে পারবে পুরসভা? এ বিষয়ে মেয়রের মন্তব্য, “আপাতত জলসঙ্কট মেটাতেই এই ভাবনা। যে মুহূর্তে পুরসভার দু’টি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরি হয়ে যাবে, তখন এই গভীর নলকূপ ব্যবহারও বন্ধ করে দেওয়া হবে। অন্যথা নাগরিকেরাই জলসঙ্কটে পড়ছেন।”
কিন্তু আর্সেনিক দূষণের সমস্যা বাড়লে তার দায় কি বর্তাবে না পুরসভার উপরেই? মেয়র বলেন, “গভীর নলকূপের জলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক উঠছে কি না, তা পরীক্ষা করে তবেই পুরসভা ওই নলকূপ ব্যবহারে অনুমতি দেবে।”
কেন কলকাতার সর্বত্র এখনও গঙ্গার পরিশোধিত জল পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছানো গেল না? পুর-কর্তৃপক্ষের যুক্তি, পাইপলাইন বসানোর কাজ পুরোপুরি না হওয়ায় এবং ধাপার জলপ্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় দক্ষিণ ও পূর্ব কলকাতার বেশ কিছু ওয়ার্ডে এখনও গঙ্গার পরিশোধিত জল পৌঁছচ্ছে না। ফলে সেই সব এলাকায় মানুষ গভীর নলকূপের উপরেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। পূর্ব কলকাতার বেলেঘাটার ৩৩, ৩৪, ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড গঙ্গার পরিশোধিত জল পর্যাপ্ত পরিমাণ যায় না। পরিশোধিত জল পায় না সংযোজিত এলাকার ১০১, ১০৫, ১০৬, ১১০, ১১২, ১১৬ এবং ১১৭ নম্বর ওয়ার্ড। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা সংযোজিত এলাকার ওই সব এলাকাকে আর্সেনিক-প্রভাবিত বলে চিহ্নিত করেছিল। ওই দূষণ রুখতে সে সব এলাকায় অবিলম্বে পরিশোধিত গঙ্গার জল পৌঁছনোর সুপারিশ করেছিলেন সমীক্ষকেরা।
বেহালায় ৯-এর দশকে একটি পরিত্যক্ত রঙের কারখানা থেকে ছড়িয়েছিল আর্সেনিক দূষণ। তাই বেহালার ভূগর্ভস্থ জলে এখনও পানের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ বলেই মনে করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞেরা। কিন্তু গার্ডেনরিচ থেকে বেহালার সব ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত জল না পৌঁছনোয় এখন ভূগর্ভস্থ নলকূপের উপরেই ভরসা করতে হচ্ছে স্থানীয় মানুষকে। পুরসভার জল সরবরাহ দফতর সূত্রে বলা হয়, বেহালার ১২১, ১২৮ এবং ১২৯ নম্বর ওয়ার্ডে গভীর নলকূপ বসিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে। কলকাতা পুরসভার সঙ্গে জোকার যে অংশটি জুড়েছে, সেখানকার তিনটি ওয়ার্ডে ৫টি গভীর নলকূপ বসানোর জন্য জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরকে অনুরোধ করেছে কলকাতা পুরসভা। কারণ ওই সব এলাকা পঞ্চায়েত থেকে কলকাতা পুর-এলাকার মধ্যে এলেও সেখানে জল সরবরাহ করে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরই।
কিন্তু কতদিন জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষা করে গভীর নলকূপের উপরে আস্থা রাখবে পুরসভা? পুরসভা সূত্রে বলা হয়, গার্ডেনরিচ জলপ্রকল্পের কাজ ২০১৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যে শেষ করতে চায় তারা। ধাপার জলপ্রকল্প চলতি বছরের মধ্যেই শেষ হবে। কিন্তু পুরসভার অভ্যন্তরের খবর, ধাপার জলপ্রকল্প এ বছরের মধ্যে শেষ করা গেলেও গার্ডেরিচ জলপ্রকল্পের পাইপ বসানোর বকেয়া কাজ আগামী বছরের মার্চের মধ্যে শেষ করা যাবে না। কলকাতা পুরসভার নির্বাচনের আগে সেই কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাই আগেভাগেই গভীর নলকূপ বসিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে জল সরবরাহ দফতর সূত্রের খবর।
গার্ডেনরিচের পাইপলাইনের কাজ শেষ করতে সমস্যা কোথায় হচ্ছে? পুরসভা সূত্রের খবর, গার্ডেনরিচ জলপ্রকল্প থেকে এখন দৈনিক ১০ কোটি গ্যালন জল সরবরাহ করা হয়। নতুন সাড়ে ছ’কোটি গ্যালন জল সরবরাহ করার জন্য যে জলপ্রকল্প হবে, তার পাইপলাইন সম্প্রসারণ করতে গিয়ে দেখা যায় জলের পাইপলাইনের উপরেই রয়েছে সিইএসসির গ্যাসের পাইপলাইন। সেগুলি সরানোর জন্য ওই সংস্থা ১০৪ কোটি টাকা চেয়েছে পুরসভার কাছ থেকে। অর্থাভাবে তা দিতে পারছে না পুরসভা। অন্য সংস্থাকে দিয়ে এখন বিকল্প জায়গায় পাইপ বসানোর কাজ শুরু হয়েছে।
পাশাপাশি মেয়র এ দিন বলেন, শহরের অনেক জায়গায় জল সরবরাহের লাইন থেকে চুরি করে জল নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। ফলে অনেক জায়গায় জলের জোগানের ঘাটতি হচ্ছে। পুরকর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে নজর রাখবেন। হাতেনাতে ধরা পরলে অভিযুক্তর বাড়ির জলের লাইন কাটা হতে পারে বলেও জানান মেয়র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy