Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মেহফিলের বাদশা ফৈয়াজ খাঁ

হ্যারিসন রোডের সেই বাড়িটায় তখন প্রায়ই বসত ধ্রুপদী সঙ্গীতের মেহফিল। সেখানে আসতেন দেশের তাবড় উস্তাদ, বাঈজি আর সঙ্গীতগুণীরা। তাঁদের কাছে এই বাড়ি ছিল তীর্থের সমান। সেই সব রঙিন মেহফিলের কথা কালক্রমে আজ ইতিহাস। সে দিন শ্যামলাল ক্ষেত্রীর বাড়িতে বসেছিল তেমনই এক আসর। সেখানে মুখ্য আকর্ষণ বিখ্যাত দুই বাঈজি, গহরজান ও মালকাজান। কিন্তু এঁরা ছাড়াও সে দিন এসেছিলেন আরও এক প্রবাদপ্রতিম। কলকাতার সঙ্গীতমহলে তখন ততটা পরিচিত না হলেও তিনি তত দিনে নিজ গুণে দেশের নানা প্রান্তে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

হ্যারিসন রোডের সেই বাড়িটায় তখন প্রায়ই বসত ধ্রুপদী সঙ্গীতের মেহফিল। সেখানে আসতেন দেশের তাবড় উস্তাদ, বাঈজি আর সঙ্গীতগুণীরা। তাঁদের কাছে এই বাড়ি ছিল তীর্থের সমান। সেই সব রঙিন মেহফিলের কথা কালক্রমে আজ ইতিহাস।

সে দিন শ্যামলাল ক্ষেত্রীর বাড়িতে বসেছিল তেমনই এক আসর। সেখানে মুখ্য আকর্ষণ বিখ্যাত দুই বাঈজি, গহরজান ও মালকাজান। কিন্তু এঁরা ছাড়াও সে দিন এসেছিলেন আরও এক প্রবাদপ্রতিম। কলকাতার সঙ্গীতমহলে তখন ততটা পরিচিত না হলেও তিনি তত দিনে নিজ গুণে দেশের নানা প্রান্তে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। আসরে যথা সময়ে হাজির হলেন আগ্রেওয়ালি মালকাজান। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন এক ভদ্রলোক। মাথায় মখমলের লাল জরিদার টুপি, কিছুটা ডান দিকে হেলানো। পরনে ফিকে সবুজ রঙের পাতলা সার্জের লং কোট। ভদ্রলোককে দেখে সকলে অনুমান করেছিলেন, হয়তো দিল্লি কিংবা লখনউর কোনও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ। আসরে কিছু কথাবার্তা, হাসিঠাট্টার পরে শুরু হল গজল। খানিক পরে, এক জন সেই নবাগত ভদ্রলোক গান ধরতে অনুরোধ করে বসলেন। খানিক পরেই শুরু হল তাঁর গান।

সে দিনের আসরে থাকা অমিয়নাথ সান্যাল ‘স্মৃতির অতলে’ গ্রন্থে সেই গান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তখন মনে হল যেন সুরের আলো জ্বলে উঠেছে। ...ধৈবত আর কোমল নিষাদের চকিত নকশা সেরে নিয়ে ফিরে এসে সমাহিত হলেন পঞ্চমে... ফুলের এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে এসে ভ্রমর বসল ফুলের উপর... ভীমপলশ্রী রাগের যত মধু, সবই বুঝি উজাড় করে ঢেলে দিল ওই পঞ্চমের ধ্বনি...।’ গানের শেষে শ্যামলাল ক্ষেত্রীর মুখেই জানা গিয়েছিল সেই ভদ্রলোকের পরিচয়। তিনি আগ্রা ঘরানার প্রবাদপ্রতিম ফৈয়াজ খা।ঁ

নাম শুনলেও, তাঁর গান শোনার সৌভাগ্য তখনও এ শহরের মানুষের বড় একটা হয়নি। আসর জমাতে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। মেহফিলে প্রতিটি গানের মধ্যে রং তৈরি করতেন। আর সেই রং ছড়িয়ে পড়ত মেহফিলে এবং শ্রোতার মনে। সে কারণেই তাঁকে বলা হত ‘মেহফিল কা বাদশা’।

প্রথম দিকে কলকাতায় এলে ফৈয়াজ খাঁ মালকাজানের ইন্ডিয়ান মিরর স্ট্রিটের বাড়িতে উঠতেন। শোনা যায় এই আগ্রেওয়ালি মালকাজানকে ছাড়া বেশির ভাগ বাঈজিকে অপছন্দ করতেন ফৈয়াজ খাঁ।

তাঁর জন্ম ১৮৮০তে (মতান্তরে ৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৮১) আগ্রায়। জন্মের আগেই ফৈয়াজ বাবাকে হারিয়েছিলেন। তাঁকে বড় করে তুলেছিলেন দাদু গুলাম আব্বাস খান। শৈশব কেটেছিল সাঙ্গীতিক পরিবেশে। পিতৃ-মাতৃকূল দু’দিকেই ছিল সে যুগের প্রবাদপ্রতীম সঙ্গীতশিল্পীরা। ফৈয়াজের শিক্ষা শুরু হয়েছিল গুলাম আব্বাসের কাছে। পরবর্তী কালে আগ্রা ঘরানার কাল্লান খান ও মহম্মদ আলি খানের কাছে। তবে শুধু খেয়াল বা ধ্রুপদই নয়, তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল ঠুমরি, দাদরা এমনকী হোলির গানেও।


মাঝখানে ফৈয়াজ খাঁ

শোনা যায়, ছেলেবেলা থেকেই ফৈয়াজ তাঁর দাদুর সঙ্গে বিভিন্ন রাজ-দরবারে সঙ্গীতের আসরে যেতেন। এক সময় তিনি মহীশূর দরবারের গায়ক নাত্থান খানের সংস্পর্শে আসেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে, মহীশূর দরবারে ফৈয়াজের সঙ্গীত পরিবেশনে মুগ্ধ হয়ে রাজা তাঁকে সোনার মেডেল উপহার দেন।

১৯১২তে বরোদার মহারাজ শিবাজি রাও গায়কোয়াড় তাঁকে সভাগায়ক নিযুক্ত করেন। এ জন্য তিনি বরোদায় থাকতেন। পরে ১৯২৫-এ মহীশূরের মহারাজা তাঁকে আফতাব-এ-মৌশিকি উপাধিতে ভূষিত করেন। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথও ভালবাসতেন ফৈয়াজের গান। তাই, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর গানের আসর বসেছিল।

মহিষাদলের কুমার দেবপ্রসাদ গর্গের একটি প্রবন্ধ থেকে ফৈয়াজ খাঁর ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে নানা কথা জানা যায়। ভোর চারটের নমাজের সঙ্গেই তাঁর দিন শুরু হত। খাটে শুয়ে উদার সপ্তকে ‘সা’ সাধতেন। ডায়াবিটিস ছিল বলে খাওয়াদাওয়া নিয়ে নানা হাঙ্গামা ছিল। সকাল সাড়ে ছ’টা-সাতটার মধ্যে স্নান সেরে আতর মেখে গান শেখাতে বসতেন। গান শেখানোর সময় উনি বাইরের কারও উপস্থিতি পছন্দ করতেন না। তেমন হলে, গান শেখানো বন্ধ করে দিতেন। এক আচকান ছাড়া নিজের পাজামা, পাঞ্জাবি বা শার্ট নিজে কেটে সেলাই করতেন।

সঙ্গীত শিক্ষার ব্যাপারে ফৈয়াজ খাঁ প্রথাগত গুরুশিষ্য পরম্পরায় বিশ্বাসী ছিলেন। সঙ্গীত বিদ্যালয়ে বইপত্রের মাধ্যমে সঙ্গীত শিক্ষা তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর সাগরেদদের মধ্যে আতা হুসেন খান, খাদিম হুসেন খান, লতাফৎ হুসেন খান, শরাফত হুসেন খান, এস রতনজংকার দিলীপচন্দ্র বেদী উল্লেখযোগ্য।

পরের দিকে কলকাতায় এলে খাঁ সাহেব হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির বাড়িতে থাকতেন। হিন্দুস্থান কোম্পানির দোতলার সেই ঘরে আসতেন বহু গণ্যমাণ্য ব্যক্তি। এক বার গাণ্ডা বাঁধার জন্য এসেছিলেন বিখ্যাত গায়ক অভিনেতা কুন্দনলাল সায়গল। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের একটি লেখা থেকে এ বিষয়ে জানা যায় যে, সায়গল সাহেব বললেন, ‘‘ওস্তাদ, কিতনা কামাল কা ভৈরবী হ্যায় আপকা ,‘বাবুল মোরা নৈহার’। মেহেরবানি কর আপ মুঝে ওহি শিখাইয়ে।” খাঁ সাহেব বললেন, “আরে সায়গল, তুমনে যো ‘বাবুল মোরা নৈহার’ গায়া, ইসকে মুকাবিলে মে মৈঁ বিলকুল নাচীজ হুঁ।”

ফৈয়াজ খাঁ-এর রেকর্ড

স্মৃতিচারণ করতে গিয়েই তাঁর প্রসঙ্গে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ‘তহজীব-এ মৌসিকী’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের কণ্ঠের মধ্যে একটা উদাত্ত ওজস্বিতা ছিল।... ফৈয়াজ খাঁর গান শুনে এক সময় ভারতের সমস্ত শ্রোতারা অভিভূত হ’ত, সম্মানও সবাই করত ওঁর গান শুনে। আপামর জনসাধারণের, বুঝুন বা নাই বুঝুন, ওঁর গান ভাল লাগত। ...বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, ফৈয়াজ খাঁর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুগায়ক এবং শ্রোতাদের আকৃষ্ট করবার মতো বৈচিত্রভরা, ক্ষমতাসম্পন্ন গায়ক, তাঁর সময়ে কেন, তাঁর আগেও বোধহয় কেউ ছিলেন না, যাঁর জন্য উনি অত বিখ্যাত হয়ে আছেন।”

ফৈয়াজ খাঁ-র বেশির ভাগ রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে। এ ছাড়া গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর কিছু রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। শোনা যায়, প্রথম দিকে গান রেকর্ড করার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। যদিও পরবর্তী কালে তিনি গান রেকর্ড করায় সম্মত হয়েছিলেন। তাঁর রেকর্ড হওয়া রাগগুলির মধ্যে অন্যতম দরবারি, ছায়ানট, পূরবী, জয়জয়ন্তী, তোড়ী, রামকলি উল্লেখযোগ্য।

জীবনের শেষ দিকে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ফৈয়াজ। ৫ নভেম্বর, ১৯৫০-এ বরোদায় তাঁর মৃত্যু হয়। সেই সঙ্গে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র স্মৃতির অতলে বিলীন হয়েছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bibhutisundar bhattacharya atiter tara faiaz khan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE