পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের গ্রেফতারের প্রতিবাদে হরিশ মুখার্জি রোডে অবরোধ।
খবরটা টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠতে না উঠতেই ভিড় জমতে শুরু করল শাঁখারিটোলার বহু পরিচিত বাড়িটার সামনে। ‘দাদা’র গ্রেফতারের খবর শুনে কেউ হতাশ, কেউ দিশেহারা, কেউ বা ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভ খানিকটা গিয়ে পড়ল সংবাদমাধ্যমের উপরে, বাকিটা কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে। এমন ‘মানুষের বন্ধু’ নেতাকে সিবিআই গ্রেফতারের পিছনে কেন্দ্রের ষড়যন্ত্রই দেখছেন মদন মিত্রের পাড়ার ঘনিষ্ঠ অনুচরেরা।
হাতের সামনে কেন্দ্রের সরকার নেই। স্বভাবতই অনুচরদের ভিড় জমার কিছুুক্ষণের মধ্যে সংবাদমাধ্যমের দিকে ভেসে এল হুমকি। তৃণমূলের এক মারমুখী কর্মীর কথায়, “আজ কিন্তু কিছুু রেওয়াত করব না। ক্যামেরা খোলার চেষ্টাই করবেন না।”
ততক্ষণে মদন মিত্রের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে পেল্লাই ‘ইনোভা’ গাড়ি। দ্রুত পায়ে বাড়ির থেকে এসে গাড়িতে উঠলেন মদন মিত্রের স্ত্রী এবং পুত্রবধূ। সঙ্গে গোটা সাতেক ফোন। মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেন, “দাদা গ্রেফতারের খবর পেয়েই তাঁদের ‘নিশ্চিত ঘাঁটি’তে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ এসেছে। আপাতত অবশ্য বৌদিদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সিবিআইয়ের দফতরে। পুরো পরিবারই দাদার পাশে আছে।” এর পরেই ওই নেতার গলায় ঝরে পড়ে ক্ষোভ, “সকলকে তো অনেক বার করে জেরার পরে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর দাদাকে ডেকেই গ্রেফতার। বলা নেই, কওয়া নেই, কোনও মন্ত্রীকে এ ভাবে গ্রেফতার করা যায়? জানেন, গ্রেফতার হওয়ার পনেরো মিনিট আগে দাদার সঙ্গে কথা হয়েছে। গ্রেফতারের বিন্দুমাত্র আভাষও ছিল না। দাদা বললেন, একটু পরেই বেরবো। তার পরেই টিভিতে দেখলাম, গ্রেফতার করা হয়েছে।”
সময় যত এগিয়েছে, মন্ত্রীর বাড়ির সামনে ভিড় ততই বেড়েছে। বছর আঠাশের এক যুুবক মোবাাইল ফোনে নির্দেশ দিলেন এক ডেকরেটর্স সংস্থাকে, “এখনও চেয়ার পাঠালে না! অন্তত ৫০টা চেয়ার পাঠাও। এখানে সারা রাত থাকতে হবে।”
তখনই মদনের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন তৃণমূল নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। সংবাদমাধ্যম ঘিরে ধরতেই বলেন, “ওকে বহু বছর ধরে চিনি। মদন খুবই ভাল ছেলে। উপকারী ছেলে। আমার স্থির বিশ্বাস, সব অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণ করে ও ঠিক বেরিয়ে আসবে। আমি সব সময়েই মদনের পাশে আছি।”
এরই মধ্যে খবর এল, মুখ্যমন্ত্রীও সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে পরিবহণমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। এর পরেই উৎসাহ ছড়িয়ে পড়ল মদন-অনুগামীদের মধ্যে। ভবানীপুর থেকেই দু’ভাগ হয়ে দু’টি দল ছড়িয়ে পড়ল যদুুবাবুর বাজার এবং এসএসকেএম চত্বরে। অবরোধ হল হরিশ মুখার্জি রোড, আশুতোষ মুখার্জি রোডে। স্লোগান উঠল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং সিবিআই-এর বিরুদ্ধে।
বিক্ষোভের ঢেউ নিমেষে ছড়িয়ে পড়ল মদনের বিধানসভা এলাকা কামারহাটি এবং সিবিআই-এর সিজিও কমপ্লেক্সের দফতরের সামনে। কোথাও স্লোগান, কোথাও মিছিল, কোথাও চলল গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়ে পথ অবরোধ। এমনকী, মদন মিত্র গ্রেফতারের প্রতিবাদে শনিবার দুপুরে গোষ্ঠ পালের মূর্তির পাদদেশ থেকে মিছিল আয়োজনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কামারহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান তৃণমূলের গোপাল সাহাও। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে এক ঘণ্টা দক্ষিণেশ্বর মোড়ে টোটো দিয়ে অবোরোধ করে কামারহাটির তৃণমূল কর্মীরা। যার জেরে যানজট হয় বালি ব্রিজ, ডানলপ, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে। কমারহাটি টাউন তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আড়িয়াদহ সখেরবাজার থেকে মিছিল বেরোয়। সাড়ে সাতটায় কামারহাটি পুরসভার সামনে বিটি রোডের রথতলা মোড়ে স্থানীয় ১৫টি ক্লাবের সদস্যরা রাস্তায় বসে পড়েন।
অন্য দিকে সল্টলেকে বিজেপি-র আবির খেলা। শুক্রবার।
আধঘণ্টা ধরে অবরোধ চলে। কাশীপুর থানার কাছে বিটি রোডও অবরোধ করেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। তা চলে বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে প্রায় ছ’টা পর্যন্ত। যানজটে স্তব্ধ হয় ব্যস্ত বিটি রোড। অন্য দিকে, বেলগাছিয়া মোড়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে অবরোধ করে প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সি মেন্স ইউনিয়ন।
ভবানীপুরের যদুবাবু বাজারের উল্টো দিকে প্রোগেসিভ ট্যাক্সি মেন্স ইউনিয়নের অফিসের দোতলায় কয়েক জন ট্যাক্সিচালক বসে মদন মিত্রের গ্রেফতারের খবর দেখছিলেন। তাঁরা জানালেন, অফিসে নেতারা কেউ নেই। সকলেই চলে গিয়েছেন সিজিও কমপ্লেক্সে, মদনদার পাশে থাকতে।
মদন মিত্র গ্রেফতার হওয়ার পরে আবার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় বিজেপি কর্মীদের মধ্যে। সল্টলেকের সিবিআই দফতরের সামনে বিজেপি কর্মীরা আবির খেলেন। মদন মিত্র গ্রেফতার হওয়ার প্রেক্ষিতে শুক্রবার সন্ধ্যায় পুরুলিয়ায় পথে নামে কংগ্রেস। শহরের ভিক্টোরিয়া স্কুল মোড়ে কংগ্রেস কর্মীরা মদন মিত্রের কুশপুতুল দাহ করেন। মদন গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই বহরমপুরের কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় উল্লাস। জেলা কংগ্রেস কার্যালয়ের সামনে বাজি ফাটানো হয়। পোড়ে মদন মিত্রের কুশপুতুল। মদনের গ্রেফতারের প্রতিবাদে তৃণমূলের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও। পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুর বাজারের নরঘাটের মাতঙ্গিনী সেতুর কাছে সন্ধ্যায় দিঘা-কলকাতা সড়ক ঘণ্টা খানেক অবরোধ করা হয়। আটকে যায় পর্যটকদের গাড়ি।
দুপুরে সারদা-কাণ্ড নিয়ে ব্যারাকপুর স্টেশনের সামনে পথনাটিকা করে কংগ্রেস। এর পরে জোর করে ব্যারাকপুরের মহকুমাশাসকের দফতরে কংগ্রেস কর্মীরা ঢোকার চেষ্টা করলে তাঁদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
পথে নেমেছে সিপিএমও। সারদা-কাণ্ডে বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে এ দিন সন্ধ্যায় এসএফআই-ডিওয়াইএফ মেদিনীপুরে মিছিল করে। স্লোগান ওঠে, ‘চোর ধরেছে সিবিআই, জেলে যাবে দিদিভাই।’
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy