Advertisement
E-Paper

শুধু কালীসাধক নন, সমাজ সচেতক কবিও রামপ্রসাদ

তিনি সাধক-কবি বলেই পরিচিত। মাতৃসাধনার পাশাপাশি তিনি বাংলাগানের এক নতুন ধারার স্রষ্টা। আবার বাংলা সাহিত্যে তিনি একটি নাম। তাঁর গানের ভক্তিরসের অভূতপূর্ব আবেদনে শ্মশানবাসিনী কালী প্রবেশ করলেন বাঙালির ঘরে ঘরে। করালবদনী হয়ে উঠলেন আদরিনী শ্যামা।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০২

তিনি সাধক-কবি বলেই পরিচিত। মাতৃসাধনার পাশাপাশি তিনি বাংলা গানের এক নতুন ধারার স্রষ্টা। আবার বাংলা সাহিত্যে তিনি একটা নাম। তাঁর গানের ভক্তিরসের অভূতপূর্ব আবেদনে শ্মশানবাসিনী কালী প্রবেশ করলেন বাঙালির ঘরে ঘরে। করালবদনী হয়ে উঠলেন আদরিনী শ্যামা। তিনি শুধুমাত্র কালীসাধক নন, এক যুগসন্ধিক্ষণের সমাজ সচেতক এক কবিও— রামপ্রসাদ সেন।

জাতিভেদ এবং ধর্মান্ধতাকে উপেক্ষা করে তাঁর কণ্ঠে ধবনিত হয়েছিল দেশমাতৃকার বন্দনা। সে কারণে তাঁর জীবন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিল।

রামপ্রসাদ সেনের জন্ম ও মৃত্যু সাল নিয়ে মতান্তর রয়েছে। যদিও অনেকেই মনে করেন ১৭১৮-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম হয়েছিল। ঠাকুরদা রামেশ্বর সেন ও বাবা রামরাম সেন দু’জনেই ছিলেন চিকিৎসক। তৎকালীন কুমারহট্টে (হালিশহরে) তাঁদের ভাল নামডাক ছিল। রামপ্রসাদের মায়ের নাম সিদ্ধেশ্বরী দেবী।

ছোটবেলায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলে তিনি বাংলা, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে রামপ্রসাদের বিয়ে হয় সর্বাণীদেবীর সঙ্গে। তাঁদের চার সন্তান ছিল। মাতৃ সাধনায় বিভোর রামপ্রসাদের সাংসারিক জীবন ছিল টানাপড়েনে ভরা।

বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে রামপ্রসাদ সেন উপার্জনের আশায় কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই নিধিরাম তাঁর চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন গরানহাটায় দুর্গাচরণ মিত্রের কাছারিতে। আনুমানিক ১৭৩৯-এ তিনি দুর্গাচরণের কাছারিতে কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে জাগতিক কাজকর্মে তাঁর মন ছিল না। কাজের সময় কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকতেন। এ ভাবেই এক দিন হিসেবের খাতায় লিখলেন, ‘আমায় দে মা তবিলদারী আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী।’ ক্রমেই সেরেস্তার হিসেবের খাতা হয়ে উঠল রামপ্রসাদের গানের খাতা। ব্যাপারটা যখন মিত্র মশায়ের কাছারিতে জানাজানি হল তখন সকলে ভেবেছিলেন এই বুঝি রামপ্রসাদের চাকরিটা গেল। হিসেবের খাতায় লেখা সেই সব গানের মাহাত্ম্য বুঝতে দেরি হয়নি বিচক্ষণ দুর্গাচরণের। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রামপ্রসাদ কোনও এক মহাসাধক। রামপ্রসাদে কণ্ঠে কয়েকটি গান শুনে তাঁর অনুমান আরও দৃঢ় হয়েছিল। দুর্গাচরণই প্রথম তাঁকে ‘কবিরঞ্জন’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি রামপ্রসাদকে হালিশহরে ফিরে যেতে বলেন এবং মাসিক তিরিশ টাকা বৃত্তি সেখানে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

তবে ঠিক কার বাড়িতে কলকাতায় তিনি কাজ করতেন তা নিয়েও মতান্তর রয়েছে। কোনও কোনও গবেষক মনে করেন তৎকালীন সময় হালিশহর ছিল সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের জমিদারির অন্তর্গত। তাই কবিরঞ্জন উপাধি নাকি তাঁরাই দিয়েছিলেন।

এর পরে শোনা যায়, রামপ্রসাদ হালিশহরে ফিরে গিয়ে মাতৃসাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন। দুর্গাচরণের পাঠানো বৃত্তিতে কয়েকটা বছর ভালো ভাবে কাটলেও এই বৃত্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কেননা ১৭৪১-এ দুর্গাচরণ নবাব আলিবর্দী খাঁ-র সভায় জহুরি রূপে যোগ দিয়েছিলেন। এবং তার পরের বছর বর্গী হামলার সময় তিনি মুর্শিদাবাদে থাকায় সেই বৃত্তি বন্ধ হয়। আবারও আর্থিক সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল রামপ্রসাদকে।


হালিশহরে রামপ্রসাদ ঘাটের তোরণ

পরে নদিয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় রামপ্রসাদকে সভা কবি হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু, রামপ্রসাদ বিনীত ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। যদিও রাজার দেওয়া জমি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিল আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধেই তিনি বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেছিলেন।

রামপ্রসাদ যে সময়ের মানুষ সেই সময়টা নানা কারণেই ঘটনাবহুল। সমাজে এসেছিল নানা বিপর্যয় এবং পরিবর্তন। ১৭৩৯-এর মহাপ্লাবন, ১৭৪২ এবং ১৭৫২-এর বর্গী হানা, ১৭৫৭-এর পলাশির যুদ্ধ আর ১৭৬৯-এর মন্বন্তর। এ সবের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল বাংলার কৃষি জীবন ও সাধারণ মানুষের উপর। এমনই এক সময় রামপ্রসাদের গান হয়ে উঠেছিল মানুষের বড় একটা আশ্রয়।

অষ্টাদশ শতকে বাংলার যে দু’জন কবি বিশেষ ভাবে পরিচিত তাঁরা রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় এবং রামপ্রসাদ সেন।

অনেকেই মনে করেন যে রামপ্রসাদ সেন কখনওই যুগপুরুষ হয়ে ওঠেননি। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার জন্য নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের নানা সময়ে কঠিন দারিদ্রতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে।

তবু আজও রামপ্রসাদী গানের জনপ্রিয়তার কারণ তাঁর গান মাটির কাছাকাছি থাকা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছে সে কাল থেকে এ কাল। আর তাই তাঁদের মুখে মুখে বেঁচে রয়েছে গানগুলি।

শুধু তাই নয় সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন রামপ্রসাদ। রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রোধ করার বহু আগেই রামপ্রসাদ সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে বলেছিলেন, ‘নহে শাস্ত্রসমত্বা সমত্বা সহমৃতা।’ রামপ্রসাদ সেন মাটির মূর্তি গড়ে কালী পুজো করলেও অনেকেই মনে করেন তিনি ছিলেন নিরাকারে বিশ্বাসী ও একেশ্বরবাদী। তার প্রমাণও মেলে তাঁর কাব্যে— ‘ভবানী শঙ্কর বিষ্ণু এক ব্রহ্ম তিনভেদ করে সেই মূঢ় জন প্রজ্ঞা হীন।’

খোদ কলকাতা শহরে তাঁকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে কিছু কিংবদন্তি। একটি কিংবদন্তি অনুসারে এক বার কলকাতা থেকে হাঁটা পথে হালিশহর ফেরার পথে রামপ্রসাদকে বন্দি করেছিল চিতে ডাকাতের উত্তরপুরুষ বিশু ডাকাত তার উপাস্য দেবী চিত্তেশ্বরীর সামনে বলি দেওয়ার জন্য। হাঁড়িকাঠের সামনে মৃত্যু আসন্ন জেনে রামপ্রসাদ দেবীস্তুতি শুরু করেছিলেন। তখনই বিশু নিজের ভুল বুঝতে পেরে রামপ্রসাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে মুক্ত করেছিলেন।

তেমনই এই মন্দিরের পাশেই চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলার মন্দিরকে নিয়ে রয়েছে অন্য একটি কাহিনি। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবী নাকি আগে দক্ষিণমুখী ছিলেন। এক দিন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন নৌকায় গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলেন। তাঁর গান শোনার জন্য দেবী নাকি পশ্চিমমুখী হয়েছিলেন। তেমনই জয়নারায়ণ ঘোষাল প্রতিষ্ঠিত দুর্গা পতিতপাবনীকে দেখে রামপ্রসাদ গেয়ে উঠেছিলেন “পতিতপাবনী পরা, পরামৃত ফলদায়িনী স্বয়ম্ভূশিরসি সদা সুখদায়িনী।” তিনিই এই স্থানটির নামকরণ করেন ভূকৈলাস।

আর্থিক অনটনে ভরা জীবনে পরিবারের প্রতি তিনি ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ। কখনও গৃহত্যাগী হয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাননি। শোনা যায়, ১৭৮৭-র বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাটির কালীমূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে তিনি নিজেও গঙ্গায় বিলীন হয়ে যান।

তাঁর মৃত্যুর পরে ক্রমেই সেই সিদ্ধপীঠ আগাছায় জঙ্গলে ভরে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষে হালিশহরবাসীর চেষ্টায় রামপ্রসাদের ভিটে ও পঞ্চমুণ্ডির আসন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে ১৯৫৭-এ সেই সিদ্ধপীঠে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy