চলছে পরিচারিকাদের প্রথম রাজ্য সম্মেলন। দমদমের রবীন্দ্রভবনে। মঙ্গলবারের নিজস্ব চিত্র।
‘‘আমাদের ছাড়া চলবে না/ সকালে বাসন মাজা হবে না। আমাদের ছাড়া চলবে না/ কাপড় কাচা হবে না।” দমদম শূরের মাঠে রবীন্দ্র ভবনের স্টেজে মাইক হাতে এক পরিচারিকা স্লোগান দিচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন প্রায় দেড় হাজার পরিচারিকা। কিছুক্ষণ অন্তর নানা ধরনের দাবিদাওয়া সংবলিত স্লোগানে ভরে উঠছে রবীন্দ্র ভবন।
দমদমের ওই রবীন্দ্র ভবনে সাধারণত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা রাজনৈতিক সভাই হয়। কিন্তু পরিচারিকাদের সভা এই প্রথম। পরিচারিকাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া তুলে ধরতে মঙ্গলবার দুপুর বারোটা নাগাদ দমদমের শূরের মাঠে রবীন্দ্র ভবনে হয়ে গেল ‘পশ্চিমবঙ্গ গৃহ-পরিচারিকা সমিতি’র প্রথম রাজ্য সম্মেলন। সাতটি জেলা থেকে আসা প্রায় দেড় হাজার পরিচারিকা দু’ঘণ্টা ধরে এই সম্মেলনে নিজেদের নানা দাবি তুলে ধরলেন। মঞ্চে মিঠু দাস নামে যিনি মাইক হাতে বক্তৃতা করছিলেন, তিনি নিজেও এক জন পরিচারিকা। তিনি অবশ্য প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছেন, “বন্ধুরা এটা আমার প্রথম মাইক হাতে ধরা। ভাল করে গুছিয়ে কথা বলতে পারছি না।” যদিও শ্রোতারা জানিয়ে দিয়েছেন, গুছিয়ে কথা বলতে না পারলেও তাঁদের নিজেদের দাবি ভাল ভাবেই ফুটে উঠেছে বক্তার কথায়।
সকাল সাড়ে এগারোটা থেকেই শূরের মাঠের সামনে লম্বা লাইন। কয়েকটি লাক্সারি বাসে করে দূর-দূরান্ত থেকেও এসেছেন পরিচারিকারা। কেউ একা এসেছেন, কারও বা কোলে শিশু। কাঁচড়াপাড়া থেকে আসা এক পরিচারিকা রুমা দাস বলেন, “বাচ্চাকে কোথায় রেখে আসব? অথচ আমাদের দাবিগুলিও তো তুলে ধরা দরকার।”
‘তোমার দেখা নাই রে’ বলে যে গান এক সময়ে জনপ্রিয় হয়েছিল, সেটিও তাঁদের কাজে না আসার আশঙ্কা থেকে লেখা বলেই মত কয়েক জন পরিচারিকার। তাঁরা জানেন, তাঁদের এক দিন কাজে না আসা মানে সেই বাড়ির রুটিন পুরো পাল্টে যাওয়া। নিজেদের এই গুরুত্ব জেনে তাঁরা ওই সভায় ব্যঙ্গচিত্রের প্ল্যাকার্ডও ঝুলিয়েছেন। তাতে লেখা, ‘তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হতো না/ তুমি না থাকলে বাসন জমতো, মেজে ওঠা হতো না।’ কাঁচড়াপাড়া থেকে আসা এক জন বলেন, “আমাদের এই সমিতির খুব দরকার ছিল। এই বছর এপ্রিল মাসে সংগঠন তৈরি হল।”
তাঁদের নানা দাবির মধ্যে যেমন রয়েছে কাজের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা ও তার ভিত্তিতে ন্যূনতম মজুরি এবং সামাজিক সম্মান-মর্যাদার অধিকার পাওয়া, তেমনই রয়েছে শ্রম আইন মাফিক বোনাস, মাসে চার দিন সবেতন ছুটি ইত্যাদি দাবি। হাতিবাগান থেকে আসা সত্তর ছুঁইছুঁই এক পরিচারিকা রবীন্দ্র ভবনের গদিওয়ালা চেয়ারে আরামে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছিলেন। বললেন, “আমাদের কাজের সময়ে নানা অপমানের শিকারও হতে হয়। যাঁদের বাড়িতে কাজ করি, অনেক সময়ে তাঁদের শৌচাগার ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। এটা কেন হবে?” তবে শুধু দাবিদাওয়া তুলে ধরাই নয়, ছিল তাঁদের জন্য খাওয়ার আয়োজনও।
এই সব নানা দাবিদাওয়া শুনতে হাজির থাকার কথা ছিল স্থানীয় বিধায়ক ব্রাত্য বসুর। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ঝড়খালিতে থাকায় সভায় যোগ দিতে পারেননি। তবে উপস্থিত ছিলেন মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়, পরিবেশকর্মী নব দত্ত, দক্ষিণ দমদম এলাকার তৃণমূল নেতা প্রবীর পাল প্রমুখ। সুনন্দাদেবী বলেন, “যাঁরা অন্যের বাড়িতে প্রদীপ জ্বালান, তাঁরাই আজকের সভায় প্রদীপ জ্বালিয়েছেন। এটাই আনন্দের কথা। তাঁদের দাবি তুলে ধরতে হবে।”
তবে শুধু তাঁদের দাবি তুলে ধরাই নয়, পরিচারিকাদেরও একটা দায়িত্ব আছে বলে মনে করেন অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। সম্প্রতি একটি বাংলা ছবিতে এক পরিচারিকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। সেখানেও নানা দৈনন্দিন সমস্যার কথাই উঠে এসেছে। তিনি বলেন, “পরিচারিকাদের কাজটাও কিন্তু একটা চাকরি। চাকরির যেমন কিছু দায়িত্ব থাকে, পরিচারিকাদেরও কিছু দায়িত্ববোধ তৈরি করতে হবে। নিজের কাজকে সম্মান করলেই দায়িত্ববোধ তৈরি হয়। মাসে চার দিন যেমন সবেতন ছুটির তাঁরা দাবি করেছেন, তেমন দিনের পর দিন কামাই হলে তার ব্যবস্থা কী হবে, তা-ও পরিচালন সমিতিকে ঠিক করতে হবে।” রূপাদেবীর মতে, “এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই আগের মতো পরিচারিকাদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয় না। আগে যে আত্মিক সম্পর্ক ছিল, সেখান থেকে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত। পরিচারিকা সমিতি কি সেই সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে পারবে?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy