Advertisement
১৮ মে ২০২৪

দুই হাজারেও ব্যাজার নয় বাঙালির নব্য কফিবিলাস

এক কাপ কফিতে তোমাকে চাই বলে ফস করে গেয়ে বসবেন না। কফির দাম কিন্তু দু’হাজার টাকা! ছাপার ভুল নয়। দুইয়ের পর তিনটে শূন্যই। এবং কলকাতা সেই কফি খাচ্ছে। পাঁচতারা হোটেল নয়, পুঁচকে কফিশপেই। টাকা ফেললে কলকাতায় নাকি বাঘের দুধও পাওয়া যায়।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৮
Share: Save:

এক কাপ কফিতে তোমাকে চাই বলে ফস করে গেয়ে বসবেন না। কফির দাম কিন্তু দু’হাজার টাকা!

ছাপার ভুল নয়। দুইয়ের পর তিনটে শূন্যই। এবং কলকাতা সেই কফি খাচ্ছে। পাঁচতারা হোটেল নয়, পুঁচকে কফিশপেই।

টাকা ফেললে কলকাতায় নাকি বাঘের দুধও পাওয়া যায়। সেটা হয়তো কথার কথা। তবে দুনিয়ার সবচেয়ে মহার্ঘ কফি এখন পান করা যাচ্ছে এই শহরে। এক কাপের দাম, ওই দু’হাজার টাকাই!। দুনিয়াখ্যাত কোপি লুয়াক যে!

কোপি লুয়াক নামের এই কফির বিশেষত্ব কী? সুমাত্রা, জাভা বালি, ফিলিপিন্স ও ইন্দোনেশিয়ার কফিখেতে এক ধরনের ভাম বিড়াল (সিভেট ক্যাট) কফি ফল খায়। কিন্তু তার দানা বা কফি বিনটা হজম করতে পারে না। খাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর ওদের শরীর থেকে বেরিয়ে আসে আস্ত বিন। কিন্তু তার আগে ভামের পাকস্থলীতে কফি দানার ২৪ ঘণ্টা ধরে ফারমেন্টেশন হয়। লুয়াক কফির গন্ধ, স্বাদ ও আমেজের আসল রহস্য ওই ফারমেন্টেশনে। ভামের মল সংগ্রহ করে, তার থেকে কফি বিন বার করে, পরিষ্কার করে, সাবেকি প্রথায় কাঠকয়লার উনুনে সেঁকে পানযোগ্য করা হয় সেই বিন। কোপি লুয়াকের ভক্ত যাঁরা, তাঁরা ওই সব মল-টলের পরোয়া করেন না। সব কিছু জেনেই খান। এই জানার জেরেই কফির স্বাদ তাঁদের কাছে বহু গুণে বেড়ে যায় কি না, সেটা অবশ্য স্পষ্ট নয়!

মাসখানেক আগে শহরের এক কফি-ঠেকে পরপর দু’কাপ লুয়াক পান করেছেন পেশায় ব্যবসায়ী, কফি-রসিক অনর্ঘ চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘আমি এমনিতে কাপুচিনোর ভক্ত। হেজেল নাট বা ক্যারামেল কাপুচিনোই খাই। কিন্তু প্রথম বার লুয়াক পান করে বুঝলাম, শুধু কফি নয়, এ একটা অভিজ্ঞতা।’’ গোলপার্ক অঞ্চলে বালিগঞ্জ টেরেসে স্বল্প পরিসরের এক কফি-ঠেকে এখন মিলছে এই কফি। দোকানের তরুণ কর্ণধার, কফি অন্তপ্রাণ ইন্দ্রনীল মল্লিক জানালেন, আড়াই সপ্তাহের মধ্যে ১৭ জন মোট ২২ কাপ লুয়াক কফি পান করেছেন ওখানে। তার মানে ওই দামে কফি চেখে দেখার মতো মানুষ কলকাতায় অন্তত ১৭ জন আছেন, যাঁদের কেউ কেউ এক কাপের বেশি লুয়াক পান করেছেন। কোপি লুয়াক ছাড়াও মিলছে কলম্বিয়া, ক্যামেরুন, ইথিয়োপিয়া, ব্রাজিল, কোস্টা রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরের কফি বিন গুঁড়ো করে তৈরি পানীয়। আর্জেন্তিনার এক ধরনের কফি বিন আবার রাম জাতীয় মদ্য দিয়ে রোস্ট করা। এই সব কফির দামও কম নয়। বিভিন্ন দেশের ২০টি দানা থেকে তৈরি কফি বিক্রি করছে ওই ঠেক।

আর এই যে রসিকজন নিজের পছন্দ মতো কফি-দানা বেছে নিতে পারছেন, সেটাই এই শহরের কফি-সংস্কৃতির সাম্প্রতিকতম উড়ান। যে কারণে বিবেকানন্দ পার্কের কাছে একটি কফি ঠেকের মেনুতে আন্তর্জাতিক বিভাগে তিন রকম কাপুচিনোর উল্লেখ। ইথিয়োপিয়ান, কলম্বিয়ান আর কোস্টা রিকান।

এগুলোর দাম সাধারণ কাপুচিনো অর্থাৎ ভারতীয় দানা দিয়ে তৈরি কাপুচিনোর চেয়ে খানিকটা বেশি।

এমনিতে কলকাতা চায়ের শহর। জলহাওয়া, আর্থিক সঙ্গতি, অভ্যাসের ভিত্তিতে চা অনেকটা এগিয়ে কফির চেয়ে। তবে বিশ্বায়নের প্রভাব ও বিদেশে যাতায়াত বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ কফিতে আসক্তি বেড়েছে শহরের মানুষের, বাঙালির। রসিয়ে কফি পান করার প্রবণতাও বেড়েছে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ারম্যান সত্যজিৎ বসু তাঁর অফিসে বসিয়েছেন কফি মেশিন, যেখানে কফি দানা থেকে সরাসরি কফি গুঁড়ো হয়ে দুধের সঙ্গে মিশছে। সত্যজিৎবাবু বলেন, ‘‘মেশিনে রাখা দানা থেকে তৈরি কফির স্বাদ-গন্ধ-আমেজই আলাদা। তবে কফি বেশি খাওয়া উচিত নয়। স্নায়ুর চাপ বেড়ে গিয়ে হাত কাঁপতে পারে, ঘুমও ভাল হয় না।’’ কোনও কোনও চিকিৎসকের মতে, কফি হৃদযন্ত্র ও পেটের পক্ষেও ভাল নয়। তবে ইন্দ্রনীলের মতো কফি-ঠেকের মালিকদের বক্তব্য, ‘‘যে কোনও জিনিসই বেশি খাওয়া খারাপ। তবে শুধু কফি কেন দায়ী হবে?’’

কফি হাউসের স্বর্ণযুগে কফি মানে ছিল দুধ-চিনি দেওয়া গরম কফি, কালো কফি বা ইনফিউশন আর বড়জোর ঠান্ডা ও ক্রিম দেওয়া কফি। তখন কিছু অভিজাত রেস্তোরাঁয় পটে করে কফি অর্ডার করা ছিল রুচি ও ঠাটবাটের পরিচয়। আর ছিল ইডলি-দোসার দোকানে দক্ষিণ ভারতীয় কফি। এর পর দু’-তিনটি আন্তর্জাতিক চেনের দৌলতে সুযোগ এল এসপ্রেসো-কাপুচিনো-কাফে লাতে-কাফে মোকা-আইরিশ কফি কিংবা কোল্ড কফি উইথ ফ্রাপের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ।

একদা শহরে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে নিয়মিত আড্ডায় বসতেন কবি-লেখক শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। সেখানে ১৯৫২-তে ৬৮ পয়সায় কেনা এক কাপ কফি তাঁরা তিন জন ভাগ করেও খেয়েছেন। চায়ের চেয়ে আজও কফি বেশি পছন্দ ৮৫ বছরের শরৎবাবুর। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে এক কাপ কালো কফির দাম এখন ১৩ টাকা আর দুধ-চিনি দিয়ে ১৭ টাকা। লুয়াকের কথা শুনে তিনি বললেন, ‘‘কিছু মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত টাকাও আছে। বিরল, দুর্মূল্য জিনিসের স্বাদ নেওয়ার ঝোঁকও আছে। সম়ঝদারি কতটা আছে, সেটা দেখার বিষয়।’’ তাই বলে এক কাপ দু’হাজার? শোনামাত্র বৃদ্ধের একটাই প্রতিক্রিয়া, ‘‘অ্যাঁ!’’

কফি কথন

লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কফি বিখ্যাত।

দানা গুঁড়ো করে সামান্য জল মিশিয়ে ‘কফি শট’ মেশিন থেকে পাত্রে পড়ে।

সেখানে সোনালি-খয়েরি রঙের সর (ক্রেমা) দেখা যায়। ক্রেমা গাঢ় মানে কফিটা জাতের।

দু’বার চুমুক দেওয়ার পর টাকরায় অনুভূত কফির স্বাদও তার জাতের নির্ধারক।

লুয়াক কফির মৃদু স্বাদ যেন ফল ও ক্রিমের যুগলবন্দি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

coffee kolkata kopi luwak
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE