Advertisement
০৫ মে ২০২৪

‘প্রতিবাদ যেন উচ্ছৃঙ্খলতায় পর্যবসিত না হয়’

রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, রাস্তায় পড়ে আছে মৃতদেহ। শূন্য রাজপথে কোথা থেকে একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল। এক শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি নেমে চাদরে মৃতদেহ ঢেকে দিলেন।

বিক্ষোভের আঁচ।

বিক্ষোভের আঁচ।

কৃষ্ণা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৪৯
Share: Save:

প্রতিবাদযোগ্য কাজের প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা জানি, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দু’জনেই অপরাধী। তবু আজকের দিনে হিংসার যে তাণ্ডব দেখছি, তাতে গা ছমছম করছে। মনে পড়িয়ে দিচ্ছে, আগেকার অনেক অভিজ্ঞতার কথা।

মনে পড়ছে স্বাধীনতা দিবস। ১৫ অগস্ট, ১৯৪৭। আমার বয়স তখন ষোলো। এক দিকে মনে অপার আনন্দ! পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি। স্বাধীনতার অনাস্বাদিত স্বাদ! অন্য দিকে, মনে গভীর বেদনা। দেশ ভাগ হয়ে গিয়েছে। আমার প্রিয় বাংলাকে অখণ্ড রাখার অনেক চেষ্টা শরৎচন্দ্র বসু, সুরাওয়ার্দিরা করেছিলেন, গাঁধীজিরও আশীর্বাদ ছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ উন্মত্ত হলে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা তখন প্রত্যক্ষ করেছি। এই কলকাতা শহরেই দেখেছি, ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’। আমার দেখা দাঙ্গায় প্রথম মৃত্যু! একা, ভীত মানুষ প্রাণভয়ে দৌড়চ্ছেন, পিছনে উন্মত্ত জনতা। যে বাড়িতে তিনি আশ্রয় নিলেন, সে বাড়ির মেয়েরা তাঁর প্রাণভিক্ষা চাইছেন। কিন্তু সে কথা কে শোনে! রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, রাস্তায় পড়ে আছে মৃতদেহ। শূন্য রাজপথে কোথা থেকে একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল। এক শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি নেমে চাদরে মৃতদেহ ঢেকে দিলেন। পরে জেনেছিলাম, তিনি ছিলেন ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক।

আরও অনেক হানাহানি দেখা ভাগ্যে ছিল! ’৪৭ সালের সেপ্টেম্বরেই রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরছি। ট্রেন যমুনা নদী পার হচ্ছে। দু’ধারে ছড়িয়ে আছে মৃতদেহ। ট্রেনের জানলা থেকে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে দেহ। দুষ্কৃতীরা আমাদের কামরাতেও হাজির হল। আমরা বাঙালি শুনে তারা বলল, ‘বাংলাতেই তো পাকিস্তান হয়েছে। তাই এদেরও ছুড়ে ফেলা যাক!’ আমার পাশে বসে ছিল পঞ্জাব থেকে আসা এক শরণার্থী মেয়ে। তার গোটা পরিবারকে লাহৌরে হত্যা করা হয়েছে। সে আশ্রয়ের খোঁজে চলেছে। আমাকে চমকে দিয়ে মেয়েটি দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। বলে উঠল, ‘তোমরা জানো না, কী করছ!’ নিজের পরিবারকে হারানো সেই মেয়েটিই তখন আমাদের রক্ষাকর্ত্রী। লোকগুলো ‘আমরা আবার ফিরে আসছি’ বলে তখনকার মতো পিছু হটল। তবে কানপুর স্টেশনে এসে মিলিটারি ট্রেন ঘিরে ফেলল। মনে হল, তখনকার মতো বেঁচে গিয়েছি।

আমাদের বাঙালিদের সৌভাগ্য, আমরা পেয়েছিলাম, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরের মতো মানুষদের, যাঁরা আমাদের মানবিকতাবাদে দীক্ষা দিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন কী ভাবে নানা ধর্মের ও নানা ভাষার মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারে। এই রাজ্যে এক অন্য আবহাওয়ায় আমরা বড় হয়েছি। এত ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও সেই আবহাওয়া একেবারে ভেঙে যায়নি। এখন ভয় হচ্ছে, এ বার কি সেটুকুও থাকবে না!

আরও পড়ুন: বিজেপির প্ররোচনাতেই এ সব হচ্ছে, বললেন ফিরহাদ ॥ দিলীপ দুষলেন তৃণমূলকে

অন্যায়ের প্রতিবাদ কী ভাবে করতে হয়, তা আমাদের নেতৃবৃন্দ শিখিয়েছিলেন। মহাত্মা গাঁধী শেখালেন, অহিংস অসহযোগ। প্রবল পরাক্রমশালী ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জনতা কী ভাবে প্রতিবাদ করতে পারে, তা দেখিয়েছিলেন তিনি। আজও সারা পৃথিবী প্রয়োজনে সেই পথ গ্রহণ করে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রথমে দেখালেন, সামনে একটা আদর্শ ধরে দিতে পারলে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান সব ভেদাভেদ ভুলে মানুষ একসঙ্গে লড়াই করতে পারে! তিনি যখন স্বাধীনতার যুদ্ধে রক্তদানের কথা বললেন, সে ছিল রণক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সমানে সমানে যুদ্ধ, নিরপরাধ মানুষের রক্ত নয়। আমরা তাঁর কথা রাখতে পারিনি। সহস্র নিরপরাধ মানুষের রক্তের উপর দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এসেছিল।
আজকের দিনে ইতিহাসের যে সন্ধিক্ষণে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তাতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই মহান নেতৃবৃন্দের থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর জোরালো রাখতে হলে শৃঙ্খলাবোধ বজায় রাখতে হবে। প্রতিবাদ যেন উচ্ছৃঙ্খলতায় পর্যবসিত না হয়। ঘোর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আর এক অন্যায় যেন ঘটে না যায়। আজ দেশে নেতৃত্বের বড়ই অভাব। তাই আমাদের যুগের নেতাদের কথা খুব মনে পড়ে। ‘গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ওই / বহিয়া চলেছে আগের মতন কই রে আগের মানুষ কই।’

(লেখিকা প্রাক্তন সাংসদ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assam NRC CAB Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE