বিধানসভা ভোটের আগে এত দিন ছিল জোট-জল্পনা। এখন শুরু হয়ে গিয়েছে জোট নিয়ে পুরোদস্তুর তরজা!
কে কার সঙ্গে জোট করবে বা আদৌ করবে কি না, তার কোনও কিছুই এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু শাসক ও বিরোধী, দু’পক্ষই চেষ্টা চালাচ্ছে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে। সেই লক্ষ্যে বামেরা যেমন তৃণমূল-বিরোধী বৃহত্তর ঐক্যের ডাক দিচ্ছে, তেমনই আবার তৃণমূল ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কংগ্রেসকে বামেদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায়!
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক জোট-আহ্বানকে কটাক্ষ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যে বামেদের আদর্শগত দেউলিয়াপনার প্রশ্ন তুলেছেন। জোট-জল্পনা নিয়ে মঙ্গলবার বর্ধমানে মমতার তির্যক মন্তব্য, ‘‘ঘোঁট করে কোনও লাভ নেই! মানুষের সঙ্গে মানুষের জোট হয়। আর সেটাই মহাজোট। সেটাই সব চেয়ে বড় জোট।’’ তৃণমূল নেত্রী যখন এমন কথা বলছেন, তখন তাঁর সাংসদ-ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিনই গড়বেতায় ব্লক তৃণমূলের সভায় দাবি করেছেন, ‘‘তৃণমূলের জন্ম না হলে কখনওই সিপিএমকে বাংলাচ্যুত করা যেত না। এখানকার (রাজ্যে) কংগ্রেস সিপিএমের বি টিম হয়ে কাজ করছে! আর ওখানকার (কেন্দ্রে) সিপিএম কংগ্রেসের বি টিম।’’ অধীর চৌধুরী থেকে শুরু করে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রেরা জোট করার জন্য উৎসুক বলে দাবি করে অভিষেকের আরও মন্তব্য, ‘‘যাঁরা কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে এসেছেন, তাঁরা কেউ কোনও দিন ভেবেছিলেন কংগ্রেসের প্রকৃত রূপ এমন হবে!’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা অবশ্য এ দিনও দাবি করেছেন, চার বছরে তাঁর সরকার এমন কাজ করেছে, ৩৪ বছরে বামেরা তো বটেই, কেউ কোনও দিন তা করতে পারেনি! তারই পাশাপাশি জোট নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কটাক্ষ শুনে বাম ও কংগ্রেস শিবিরের নেতাদের একাংশ প্রশ্ন তুলছেন, তা হলে তো কাজের নিরিখেই বিধানসভা ভোটে মমতার জয় নিশ্চিত! বিরোধীরা জোট করবে কি না, তা নিয়ে শাসক দলের এত মাথাব্যথা কেন? তার মানে কি তৃণমূল নেতৃত্ব ভিতরে ভিতরে বুঝতে পারছেন, বাম-কংগ্রেস জোট হয়ে গেলে তাঁদের রাস্তা মসৃণ না-ও হতে পারে!
তবে তৃণমূল শিবিরের একাংশ জানাচ্ছে, একক ভাবেই বিধানসভার বৈতরণী পার হওয়ার ব্যাপারে তারা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু বামেদের থেকে কংগ্রেসকে দূরে রাখতেই সনিয়া গাঁধীর দলের সঙ্গে জোট-সম্ভাবনা তারা ভেবে দেখবে। তবে এখন যে ৩১ জন বিধায়ক আছেন কংগ্রেসের, শুধু সেই আসনগুলিই তাদের ছাড়া হবে। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, ‘‘২০১১ সালেও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে লড়েছি। এখন কংগ্রেসের যে কয়েকটি আসন রয়েছে, সেগুলি ধরে রাখতে তারা তৃণমূলের সঙ্গে জোট করতে চাইলে ভাবা যেতে পারে।’’
এই পরিস্থিতিতে বামেরা বৃহত্তর ঐক্যের কথাই বলছে। কৃষ্ণনগরে এ দিন বাম গণসংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ বিপিএমও-র সমাবেশে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবু বলেছেন, ‘‘অনেকে বলছেন জোট কী হবে? ভোট আসছে তাই জোট-জোট করছেন! আমরা বলছি, বিপিএমও-র জোট। মানুষের জোট।’’ যাঁরা অন্যান্য দলের সমর্থক, এমনকী তৃণমূলেরও, রাজ্যে গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে তাঁদের কাছে টানার বার্তাও ফের দিয়েছেন সূর্যবাবু। রাজ্যের নানা প্রাম্তে বামেদের মিছিল-সমাবেশ, লড়াইয়ের বাতাবরণ দেখে তৃণমূল আতঙ্কগ্রস্ত বলে দাবি করেছেন তিনি। ফের বলেছেন, তাঁদের লক্ষ্য তৃণমূল সরকারকে উৎখাত।
তাঁদেরও লক্ষ্য অভিন্ন জানিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী মুখ্যমন্ত্রীকে পাল্টা বিঁধেছেন, ‘‘বাম-কংগ্রেস জোট হলে উনি আদর্শের প্রশ্ন তুলছেন! যখন তিনি বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, সেটা কোন আদর্শের ভিত্তিতে ছিল?’’
বাম শিবিরে অবশ্য কংগ্রেস-প্রশ্নে এখনও যথেষ্ট অস্বস্তি আছে। কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় তাদের আপত্তির কথা আলিমুদ্দিনে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় জানিয়ে এসেছিল সিপিআই। দলের নেতা মঞ্জুকুমার মজুমদার এ দিন ফের বলেছেন, ‘‘৭২ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে কিছু আসন পেয়েছিলাম। কিন্তু তার খেসারত আজও দিচ্ছি! কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়ার দরুণ আমাদের সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল হয়েছে। ফের একই ভুল করলে ভবিষ্যতে আর উঠে দাঁড়াতে পারব না!’’ কংগ্রেসকে কাছে টানতে গেলে বৃহত্তর বাম ঐক্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মঞ্জুবাবুদের যুক্তি। গোটা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ৬-৭ ফেব্রুয়ারি দলের রাজ্য পরিষদের বৈঠক ডেকেছে সিপিআই।
এই আপত্তির পাল্টা যুক্তি এ দিনই দুর্গাপুরের একটি সভায় দিয়েছেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘মনে করুন, প্রতিবেশীর সঙ্গে আপনার ঝগড়া রয়েছে। আপনার বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। তখন প্রতিবেশী সাহায্য করতে এলে আপনি কি নেবেন না? আবার প্রতিবেশীর বাড়িতে ডাকাত পড়লে আপনিও কি চুপ করে বসে থাকবেন?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy