Advertisement
E-Paper

কামদুনিতে চরম সাজা, আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল আনসার-সইফুলরা

চূড়ান্ত রায় ঘোষণার সময় গলাটা যেন একটু খাদে নেমে গেল বিচারকের! শনিবারের বারবেলা। বিচার ভবনে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের এজলাস জুড়ে তখন শুধুই স্তব্ধতা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:১৩

চূড়ান্ত রায় ঘোষণার সময় গলাটা যেন একটু খাদে নেমে গেল বিচারকের!

শনিবারের বারবেলা। বিচার ভবনে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের এজলাস জুড়ে তখন শুধুই স্তব্ধতা। নিজের আসনে বসে বিচারক সঞ্চিতা সরকার একে একে ডাকলেন সইফুল আলি, আনসার আলি ও আমিন আলির নাম। তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘আপনাদের ফাঁসির সাজা দেওয়া হচ্ছে।’’

এ দিন বেলা এগারোটায় এজলাসে হাজির হওয়ার পর থেকেই কাঠগড়ায় বসে টানা কেঁদে গিয়েছে পাঁচ জন। ব্যতিক্রম ছিল শুধু আনসার। বিচারক এজলাসে এসে বসতেই শরীরটা টান টান করে উঠে দাঁড়ায় আনসার। রায় শুনে কাঠগড়ায় হাতটা ঘষে নিল কয়েক বার। তার পরে পাশে দাঁড়ানো অন্য দু’জনের দিকে ঘুরে তাকাল। সইফুল ও আমিনের তখন চোখে জল। নিজেকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল আনসার। কিন্তু সে আর কতক্ষণ! থমথমে মুখ নিয়ে এজলাস ছেড়ে কোর্ট লকআপে ঢুকেই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না আনসার আলি। আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল। অথচ বৃহস্পতিবার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও আদালত থেকে বেরোনোর সময় সে মৃতার মা-ভাইয়ের দিকে চটি হাতে তেড়ে গিয়েছিল। ‘তোদেরও একই ভাবে মারব’ বলে হুমকিও দিয়েছিল। কিন্তু শুক্রবার সাজার শুনানির পরেই ভেঙে পড়েছিল সে। এ দিন কোর্ট লকআপে আনসার যখন কাঁদছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো ইমামুল ইসলাম, ভোলা নস্কর, আমিনুর ইসলামদেরও তখন চোখে জল। আনসারদের মতো ওদের ফাঁসির সাজা হয়নি। বিচারক জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘আপনাদের আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হল।’’

আমেরিকান সেন্টারের সামনে জঙ্গি হামলার ঘটনায় ২০০৫ সালে আফতাব আনসারি-সহ ছ’জনের ফাঁসির নির্দেশ দিয়েছিল আলিপুরের বিশেষ আদালত। তার পরে এক সঙ্গে এত জনকে ফাঁসির

সাজা শোনালো রাজ্যের কোনও আদালত। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের পরে আফতাবদের সবার ফাঁসির সাজা রদ হয়ে গিয়েছে। কামদুনির সাজাপ্রাপ্তেরাও হাইকোর্টের শরণাপন্ন হবেন বলে জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবীরা।

ছয় অভিযুক্তকে যে সব ধারায় আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছিল, তাতে যে সর্বোচ্চ সাজার বিধান রয়েছে, এ দিন সেটাই দিয়েছেন বিচারক। কেন তিনি সর্বোচ্চ সাজা দিলেন, তা রায়ে উল্লেখও করেছেন তিনি। বিচারক রায়ে লিখেছেন, ‘এই অপরাধ দেখে মনে হচ্ছে, ব্যক্তিগত আক্রোশ নয়, স্থানীয় লোকজনকে ভয় দেখাতেই এই অপরাধ করা হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের এক জন সাক্ষ্য দিতে এসে জানিয়েছেন, মৃতার গোপনাঙ্গে আঘাতের ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে, তাঁকে নৃশংস ভাবে ধর্ষণ করা হয়েছিল’।

দোষীদের আইনজীবীদের কেউ কেউ এই মামলাকে ‘বিরলতম ঘটনা’ নয় বলে সওয়াল করলেও বিচারক রায়ে বলেন, ‘এই ঘটনা যদি বিরলতম না হয় তা হলে কোনটা হবে!’ সরকারি কৌঁসুলি অনিন্দ্য রাউথ বলেন, ‘‘এই ঘটনা বিরলতম অপরাধ। তাই এই মামলায় ফাঁসি হওয়া উচিত, তা আদালতকে বোঝাতে পেরেছিলাম।’’

রায়ের প্রতিলিপি নেওয়ার সময় পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিল সাজাপ্রাপ্তেরা। আনসার দাদার হাতে রায়ের প্রতিলিপি তুলে দিয়ে নিচু গলায় কিছুক্ষণ কথা বলে। বৌদির হাতে রায়ের প্রতিলিপি তুলে দিয়ে আমিন আলির মন্তব্য, ‘‘কিছুই জানলাম না, ফাঁসি হয়ে গেল! মঙ্গলবার দুই ছেলেকে নিয়ে জেলে দেখা করতে এস। দরকার হলে বাড়ি বেচে দিও।’’

যে সব ধারায় ছ’জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তাতে কয়েক জনের যে ফাঁসির আদেশ হবে, এটা আঁচ করতে পেরেছিলেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি, রাজদীপ বিশ্বাস এবং সঞ্জীব দাঁ। এ দিন বেলা ১১টা ৫ মিনিটে শুনানি শুরু হতেই তাঁরা আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কামদুনির মতো বহু নৃশংস অপরাধে সুপ্রিম কোর্ট ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে। আনসারের আইনজীবী আশিস খান বিচারককে বলেন, ‘‘আপনি কী সাজা দেবেন, তা তো ঠিক করেই ফেলেছেন! টিভিতে তো তা দেখানো শুরু হয়ে গিয়েছে!’’ যা শুনে বিচারক বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছি কি না, তা আমি নিজেই জানি না!’’

সরকারি আইনজীবীরা আদালতে বলেন, ‘‘মূল অভিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে যে ভাবে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে, এক জন অপরাধী না হলে তা করা যায় না। এদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া উচিত।’’ বিচারক আসামীদের বক্তব্য জানতে চান। প্রত্যেকেই নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন।

এ দিন সাজা ঘোষণার পরে মৃতার বাবা-ভাইকে গাড়িতে তুলে নেয় পুলিশ। গাড়ি চলতে শুরু করতেই মৃতার বাবা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলেন, ‘‘খুশি, খুশি, খুশি।’’ ভাই বলেন, ‘‘সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় আমরা খুশি। দু’জনকে বেকসুর খালাস করার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করব।’’

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আদালত থেকে জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমে বের করা হয় সইফুলকে। ক্যামেরা থেকে মুখ লুকোতে রায়ের কপি দিয়ে নিজেকে আড়াল করে সে। তাকে আলাদা একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। তার পরে একে একে বের করা হয় বাকি পাঁচ জনকে।

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy