Advertisement
E-Paper

দ্বন্দ্বের হাওয়ায় একটাই দাবি, ভোট দিতে চাই

কথাটা যে একেবারে অমূলক নয়, তা জানান দিল কাটোয়া, পূর্বস্থলী-দক্ষিণ, পূর্বস্থলী-উত্তর, কালনা, রায়না, মেমারি আর জামালপুর বিধানসভা এলাকা। বর্ধমান পূর্ব (তপ) লোকসভা কেন্দ্রের ওই সব বিধানসভা এলাকায় সেই হাওয়ার অস্তিত্ব মিলল।

কাজল গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৫০
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

ভ্যাপসা গরম, চার দিক গুমোট, কোথাও যেন কোনও হাওয়া নেই। তবুও যেন ক্লান্তিহীন প্রবীণ রিকশাচালক। নির্বাচন দোরগোড়ায়। তাই সার্বিক আবহাওয়া নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই এল সংক্ষিপ্ত উত্তর— ‘‘চার দিকে হাওয়া। আরাম লাগতে পারে, আবার শরীরে জ্বালাও ধরতে পারে।’’

কথাটা যে একেবারে অমূলক নয়, তা জানান দিল কাটোয়া, পূর্বস্থলী-দক্ষিণ, পূর্বস্থলী-উত্তর, কালনা, রায়না, মেমারি আর জামালপুর বিধানসভা এলাকা। বর্ধমান পূর্ব (তপ) লোকসভা কেন্দ্রের ওই সব বিধানসভা এলাকায় সেই হাওয়ার অস্তিত্ব মিলল। কোথাও সরব, কোথাও তার নীরব উপস্থিতি।

এক সময়ের বাম দুর্গ বর্ধমানের রাশ তৃণমূলের হাতে। বিরোধী দল বাম কিংবা কংগ্রেস তাদের অতীতের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। বরং বিজেপির পারদ তুলনায় ঊর্ধ্বমুখী। অন্তত হাওয়া বলছে সে কথা।

গোটা লোকসভা কেন্দ্র জুড়ে সাধারণের আলোচনা থেকে বিরোধীদের প্রচারে ‘অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর’-এর কথাই ঘুরছে। কিন্তু আদৌও তার প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে দ্বিধাও স্পষ্ট। তার একটাই কারণ, সংগঠনের নিরিখে শাসক দল অনেক এগিয়ে। ফলে ফ্যাক্টর যা-ই থাকুক, প্রভাব পড়বে না বলেই অভিমত অনেকের।

জিএসটির দৌলতে তাঁত শিল্পীদের বিপর্যস্ত অবস্থা, সারের দাম বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, সহায়ক মূল্য না-মেলা, কর্মসংস্থানের অভাব, নদীভাঙন থেকে শুরু করে একাধিক ইস্যু সেই ‘অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর’কে জোরাল করে তুলেছে।

যদিও এই কেন্দ্রের শাসক দলের মূল কান্ডারি জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের কথায়, ‘‘হাওয়া একটাই। তা হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে উন্নয়নের হাওয়া। বাকিটা স্রেফ কাগুজে। বাস্তবে তার প্রভাব পড়বে না।’’ তাঁদের অভিযোগ, কেন্দ্র শুধু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বদলে জিএসটি, নোট বাতিলের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। কর্মহীন হয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। কৃষক থেকে তাঁত শিল্পীরা তার বাইরে নয়। এক দিকে বামেদের রেখে যাওয়া ঋণ, অন্য দিকে কেন্দ্রের বঞ্চনা সত্ত্বেও এ রাজ্যের উন্নয়ন শুধু দেশে নয়, বিশ্বে স্বীকৃত হয়েছে। তা ছাড়া, ধর্ম-সম্প্রদায়ে মানুষকে ভাগ করার লক্ষ্যে বিজেপির এজেন্ডা মানুষ দেখেছে। তেমনই তার বিরুদ্ধে তৃণমূলের লড়াইও দেখছে।

কালনার অস্থায়ী কার্যালয়ে বসে বিজেপি প্রার্থী পরেশ চন্দ্র দাস বলছেন, ‘‘আপনাকে শুধু ল্যাপটপ দিলাম, বাকি কিছুই নয়। তা হলে সেই ল্যাপটপ কাজে লাগে? তৃণমূলের উন্নয়ন হচ্ছে এ রকমই।’’ যদিও লোকসভা কেন্দ্রের পথঘাট, কিষাণ মান্ডি থেকে শুরু করে শপিং মলের মতো তাঁতের হাট, সেতু কিন্তু অন্য ছবির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সিপিএম প্রার্থী ঈশ্বরচন্দ্র দাস বলছেন, ‘‘এতই যদি উন্নয়ন, তবে কৃষক, শ্রমিক, তাঁত শিল্পীদের দুরবস্থা কেন, কেনই বা বেকারদের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। কেন্দ্র থেকে রাজ্যে এমনই উন্নয়নের মিথ্যা প্রচার চলছে। দেশ জুড়ে বামপন্থীরাই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলছেন।’’

কার্যত একই সুরে কংগ্রেসের প্রার্থী সিদ্ধার্থ মজুমদার বলছেন, ‘‘কেন্দ্র এবং রাজ্যে উন্নয়ন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মানুষ।’’

কালনার সিংহেরকোনে দলীয় কার্যালয়ে বসে এই কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদ তথা এ বারেও তৃণমূল প্রার্থী সুনীলকুমার মণ্ডল বলছেন, ‘‘গত বছরগুলিতে দলমত নির্বিশেষে উন্নয়নের কাজ করা হয়েছে। বর্ধমানের মানুষ জানেন সে কথা।’’ তাঁদের হিসেব বলছে, কৃষি থেকে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সেতু নির্মাণ, নতুন কলেজ, হস্টেল, বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করা থেকে ফ্লাড সেন্টার, সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ, শ্মশান, চুল্লি, শৌচালয় থেকে বেকার যুবক-যুবতীদের স্বনির্ভর করে তোলার কাজ করা হয়েছে।

তবে তাঁদের অভিযোগ, কেন্দ্র সরকারের টালবাহানায় ভাগীরথির ভাঙন মোকাবিলার কাজ এবং বাঁধ তৈরির কাজ করা যায়নি। বিজেপি বলছে, বিদায়ী সাংসদের অভিযোগ মিথ্যা।

সিপিএম নেতা অচিন্ত্য মল্লিকের কথায়, ‘‘পরিকল্পনামাফিক বিজেপি পক্ষে হাওয়া তোলার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সংগঠন না-থাকলে কিছুই হয় না। মূল সমস্যা থেকে অন্য দিকে দৃষ্টি ঘোরান হচ্ছে। আর সংবাদমাধ্যম সে কথাই বলছে।’’

হাওয়া কার পক্ষে তা নিয়ে এমন কাজিয়া আপাতত বাগ্‌যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ। তবে সাধারণ ভোটাররা চাইছেন অবাধে ভোট দিতে। সেই প্রশ্নেই সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি তুলেছেন বিরোধীরা। তাঁদের অভিযোগ, পঞ্চায়েত ভোটে মানুষ কার্যত ভোট দিতে পারেননি। বিশেষত, কাটোয়াতে। মানতে নারাজ তৃণমূল নেতৃত্ব। কাটোয়ার তৃণমূল নেতা রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘গত ৫ বছরে মোদী সরকারের স্বরূপ সকলে দেখেছে। ফলে বিজেপির প্রভাব আগের চেয়ে কমছে।’’

তৃণমূল নেতৃত্বের কথায়, সংগঠন নেই, রাম-বাম মিলেছে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। মাটি পাচ্ছেন না বলেই অপপ্রচারের পথে হাঁটছেন বিরোধীরা।

হাওয়া ঘুরবে, না একই পথে চলবে, তা সময়ই বলবে। তবে আপাতত ভোটযুদ্ধের হাওয়ায় দ্বন্দ্বের গোপন অসন্তোষও ছিদ্রপথে বেরিয়ে আসছে। দলীয় ক্ষমতার রাশ নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। নতুন-পুরনোর দ্বৈরথ। আবার পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বের জল্পনাও ভাসছে হাওয়ায়। যদিও দ্বন্দ্বের কথা স্বীকার করছে না কোনও দলই।

কিন্তু ভোট ভাগাভাগির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সকলেই। সেখানেই হাওয়ার গতিপথ নির্ভর করছে। তৃণমূল বলছে, সিপিএম-বিজেপির ভোট ভাগাভাগির উপরে তাদের জয়ের ব্যবধান নির্ভর করবে। বিজেপি বলছে, শুধু সিপিএমের নয়, তৃণমূলের বড় অংশের ভোটও তারা পাবে। বামেরা বলছে, বামেদের ভোট কমবে না বরং বাড়বে। কংগ্রেস বলছে, ভোট তো বাড়বেই, সংগঠনও মজবুত হবে।

ফিরতি পথেও দেখা হল সেই রিকশাচালকের সঙ্গে। ভোটে হাওয়া কোন পথে আছড়ে পড়বে?

এ বারেও তাঁর জবাব সংক্ষিপ্ত— ‘‘জোর যার, হাওয়া তার, ভোটও তার।’’

Lok Sabha Election 2019 Election Campaign Conflict TMC CPM BJP Congress
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy