Advertisement
E-Paper

ভাগের ভোটে চলছে যোগের অঙ্ক

মন্ত্রীর সভা শেষ হতেই জানতে চেয়েছিলাম, ‘‘বাম এবং কংগ্রসের ভোট কি কমবে? যদি কমে কে পাবে? ’’

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:০৬

পানাগড়-মোড়গ্রাম জাতীয় সড়ক ধরে তারাপিঠের পথে ঢোকার আগেই বাঁ দিকে একফালি রাস্তা গিয়ে ঢুকছে মাঝখণ্ড, হরিওকা গ্রামে। এখন ভোটের মুখে ওই রাস্তার কিছু অংশে চলছে কংক্রিটের কাজ। হরিওকা গ্রামে ঢুকতেই দেখা গেল তৃণমূলের পতাকার সঙ্গে প্রায় জড়াজড়ি করে রয়েছে পদ্মফুলের ফেস্টুন। গাঁয়ে মণ্ডল, লেট, দাস ও চৌধুরিদের বসবাস বেশি।

গাঁয়েরই এক ঠাকুরদালানে বসে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। সবুজসাথীর সাইকেল থেকে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, বাংলার বাড়ি ওই সব প্রকল্পের সুযোগ কীভাবে মিলবে কেবল তা বোঝাচ্ছিলেন মন্ত্রী। তাতে রাজনীতির কোনও কথা নেই। কেউ কেউ তো সরাসরি প্রশ্ন করছিলেন, এলাকায় পানীয় জলের সরবরাহ কম। এ গাঁয়ের রাস্তা ভাল নয়। আশিসবাবু তাঁদের জানিয়ে দেন, ভোট মিটুক। তার পরে হবে।

মন্ত্রী তাঁদের যখন আশ্বস্ত করতে ব্যস্ত, তখন অদূরেই এক বৈঠকখানায় বসে থাকা জনাপাঁচেক বাসিন্দা শাসকদলের সমালোচনায় ব্যস্ত। বললেন, ‘‘গত ৫ বছরে একবারও স্থানীয় সাংসদের মুখ দেখিনি।’’ এও স্বীকার করলেন, তাঁদের গাঁয়ে বিজেপির তেমন কোনও সংগঠন নেই ঠিকই। তবে ভোটে একটা চোরাস্রোত বইছে। সেই স্রোত কোথাও তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দের কারণে, কোথাও বা শাসকদলের স্থানীয় একশ্রেণির নেতাকর্মীর প্রভাব প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে বলে মনে করছেন তাঁরা। মন্ত্রীর সভা শেষ হতেই জানতে চেয়েছিলাম, ‘‘বাম এবং কংগ্রসের ভোট কি কমবে? যদি কমে কে পাবে? ’’ ইংরাজির প্রাক্তন এই অধ্যাপক দীর্ঘদিন ধরে রামপুরহাটের বিধায়ক। বললেন, ‘‘বিজেপিকে কেউ চায় না। বাম এবং কংগ্রেস ভোট শাসকদলের পক্ষেই থাকবে।’’ সেটা বুঝেছেন বলেই রামপুরহাট ও মুরাইয়ের কংগ্রেস নেতারাও তৃণমূলে সম্প্রতি এসেছেন বলে দাবি তাঁর। যদিও কংগ্রেস প্রার্থী ইমাম হোসেনের দাবি, কংগ্রেসের ভোট বাক্স অটুট। দলের গদ্দারেরা তার টের পাবে।’’

উন্নয়নের কথা তুলতে গিয়ে বীরভূমের অন্যতম তীর্থস্থান তারাপিঠের প্রসঙ্গ তুললেন রামপুরহাট (২) নম্বর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি সুকুমার মুখোপাধ্যায়। বললেন, ‘‘উন্নয়নের এই ধারা আমাদের প্লাস পয়েন্ট। শুধু এখানে নয়, পাথরচাপুড়িও সাজিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আমরা উন্নয়ন করে ভোট চাইছি। আর ওরা ৫ বছর ধরে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছে।’’

মহম্মদবাজারে একটা মিছিলের সামনে একটা টোটোতে চেপে প্রচার চালাচ্ছিলেন বিজেপির প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডল। পুজোর ভাসানের মত তাসাপার্টির বাজনা মিছিলে। জানকয়েক কিশোর ও যুবক নাচছিলেন। তেমন ভিড় ছিল না। কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি নেই। বললেন, ‘‘২০১১ সালের কথা মনে আছে। প্রচারে, লিখনে পাল্লা ভারী ছিল বামেদের। জিতল তৃণমূল।’’ কেন মানুষ ভোট দেবে বিজেপিকে? বললেন, ‘‘স্টেবল গর্ভমেন্ট। এবল্ প্রাইম মিনিস্টার।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

যদিও ওই কেন্দ্রে গত লোকসভা এবং বিধানসভা কেন্দ্রের ফলাফলের পরিসংখ্যান বিজেপিকে পিছিয়েই রেখেছে। ২০১৪ সালে প্রবল মোদী ঝড়েরও তৃণমূলের চেয়ে প্রায় সওয়া দু’লক্ষ ভোটে পিছিয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। বামেরা দ্বিতীয় ছিল। ওই কেন্দ্রের অধীনে ৭টি বিধানসভা দুবরাজপুর, সিউড়ি, সাঁইথিয়া, রামপুরহাট, হাসন, নলহাটি এবং মুরারই। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে এই ৭টির মধ্যে ৬টিতেই জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। হাসন কেন্দ্রে জেতে কংগ্রেস। বিজেপি সবেতেই তৃতীয়।

নলহাটিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবার্চনী জনসভার ফাঁকে কথা হচ্ছিল তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায়ের সঙ্গে। ‘‘এ বার কাকে আপনাদের মূল প্রতিপক্ষ বলে মনে করছেন?’’ জবাব এল, ‘‘সমকক্ষ না হলেও বিজেপিকেই প্রতিপক্ষ বলে মনে করছি।’’ কেন? শতাব্দীর উত্তর, ‘‘ওরা তো ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করছে। যা ভয়ঙ্কর ।’’ অর্থাৎ উন্নয়ন বনাম ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির লড়াই, দাবি শতাব্দীর। অভিযোগ, বেশ কিছু গ্রামের মানুষ আপনাকে গত ৫ বছরে দেখেননি? বললেন, ‘‘এই কেন্দ্রে ২২০০ গ্রাম রয়েছে। বছরে ৩৬৫টা দিন। সব গ্রামে ঘোরা কী সম্ভব?’’ তবে প্রতিটি গ্রামে না গেলেও উন্নয়নের কাজে তিনি যে সজাগ তা বোঝাতে জানালেন, সারা দেশের ৫৪৩ জন সাংসদের মধ্যে উন্নয়ন তহবিল খরচের তালিকায় তিনি চতুর্থ। দেখালেন সংসদের দেওয়া সেই স্বীকৃতির নমুনাও।

কিন্তু শুধুই কী ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি? ভিন্ন মত, খয়রাশোল, দুবরাজপুরের স্বাধীন দাস, সাধন মণ্ডলদের। বলছেন, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি এ জেলার সিংহভাগ মানুষ। এ বারের ভোটে তার প্রভাব পড়বে। শাসক দলের ‘কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি প্রকল্পের অনুদান বন্টনেও। মুখ্যমন্ত্রীর জনহিতকর প্রকল্প রূপায়নকে কেউ কেউ অসৎ উপায়ে টাকা রোজগারের ‘ধান্দা’ করে নিয়েছেন। যদিও তার প্রভাব ভোটে পড়বে না বলে মনে করছেন জেলায় কেষ্টদার প্রধান সেনাপতি অভিজিৎ ওরফে রানা সিংহ। তাঁর আত্মবিশ্বাস, ‘‘এলাকার উন্নয়ন যদি জনমত আদায়ের অন্যতম ভিত্তি হয়, তা হলে ভোটের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক যোজন এগিয়ে আছি।’’ কিন্তু ধর্মীয় মেরুকরণ? নলহাটির লোহাপুরের বাসিন্দা মুশা হকের পরিবারের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছত্রছায়ায় পশ্চিমবঙ্গে নিরাপদে আছি।’’

রাজ্য রাজনীতিতে বামেরা অনেকটাই পিছিয়ে। সবর্ত্রই একটায় রব, বামেদের ভোট কি বিজেপিতে যাবে? দলের ভোট ধরে রাখতে চক্কর দিচ্ছেন ওই কেন্দ্রের বাম প্রার্থী রেজাউল করিম। পেশায় চিকিৎসক, রেডিওলজির অধ্যাপক বামরাজনীতির মানুষ হলেও জেলার সঙ্গে তেমন যোগ নেই। নলহাটির বিসর গ্রামের বাসিন্দা হলেও বরাবরই কলকাতায় রয়েছেন। নলহাটির বানিওরে বিধিরপুকুর মোড়ে দেখা মিলল তাঁর। ২০১৪ সালে প্রায় ৩ লক্ষ ৯৩ হাজার ভোট পেয়েছিলেন বাম প্রার্থী। এ বার কী হবে? তাঁর দাবি, ‘‘বাম ভোট অন্যদিকে যাবে না। ধরে রাখব।’’ কথা শেষে প্রার্থী চলে যেতেই স্থানীয় বাসিন্দা দিলীপ কোনাইয়ের কথায়, ‘‘এখানকার শালডাঙা, মোরগাডাঙা, কুসুমজলি, খয়েরবুনিয়া সহ আরও কিছু গ্রামে রাস্তা ভাল নয়। পানীয় জলের অভাব। এ সব কাজ বামেদের কম্ম নয়। ৩৪ বছরেও করেনি।’’ কংগ্রেস প্রার্থীকেও নিয়েও তাঁদের কোনও উৎসাহ নেই। এ বার তাই নতুন ভাবনা রয়েছে জানান তিনি। তবে সেটা কী, তা নিয়ে মুখ খুলছেন না দিলীপের মত আরও অনেকেই। এ সব বুঝেই বাম-কংগ্রেস ভোট ভাগাভাগির দিকে নজর রয়েছে তৃণমূল ও বিজেপির।

Lok Sabha Election 2019 Tarapith Birbhum Politics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy