গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
হাতে আর এক বছরও নেই। কিন্তু ‘টার্গেট’ এখনও বহু দূর। আসানসোলে দু’দিনের বিশেষ বৈঠকে পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় রাজ্য বিজেপির সাংগঠনিক অগ্রগতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বলে খবর। ২০১৯-এর ভোটে এ রাজ্য থেকে ২২টি আসন পাওয়ার যে টার্গেট অমিত শাহ বেঁধে দিয়েছেন, সেখানে পৌঁছতে বাংলায় খুব দ্রুত সংগঠন বাড়াতে হবে বিজেপিকে। বিশেষ বৈঠকে এমনই বার্তা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখেই করা হবে, এমন সিদ্ধান্তও হয়েছে। আর তার পরেই বেশ কিছু লোকসভা আসনে বিজেপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামও ভেসে উঠতে শুরু করেছে।
সবচেয়ে বেশি ভাসছে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের নাম। মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হতে পারেন তিনি। খবর বিজেপি সূত্রের। দিলীপ নিজে এ বিষয়ে মন্তব্য করেননি। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রেই এ খবর পাওয়া গিয়েছে।
মেদিনীপুর থেকে দিলীপ ঘোষ লড়তে পারেন— এই জল্পনার আরও কিছু কারণ রয়েছে। দিলীপ ঘোষ যে কেন্দ্রের বিধায়ক, সেই খড়্গপুর সদর বিধানসভা কেন্দ্রটি মেদিনীপুর লোকসভাতেই পড়ে। ২০১৬-য় বিধায়ক হওয়ার পর থেকে দিলীপের কার্যকলাপ মূলত খড়্গপুর সদরেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি মেদিনীপুর শহর, খড়্গপুর গ্রামীণ, দাঁতন, কেশিয়াড়ি-সহ একাধিক বিধানসভা কেন্দ্রে দিলীপ ঘনিষ্ঠরা অত্যন্ত সক্রিয় হয়েছেন। বিধায়ক বা জনপ্রতিনিধি হিসেবে ওই সব এলাকার জন্য দিলীপের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু দিলীপ ঘনিষ্ঠরা এই বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে নিয়মিত যাতায়াত করছেন, সংগঠন দ্রুত বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, নানা প্রয়োজনে এলাকার লোকজনকে সাহায্য করে জনসংযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। প্রত্যেকটি বিধানসভা কেন্দ্রই মেদিনীপুর কেন্দ্রের অন্তর্গত। পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে দাঁতনে বিজেপির বেশ বাড়বাড়ন্তও নজরে এসেছে।
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর ঢাল কেন্দ্রীয় আইন, লোকায়ুক্তে ছাড় বহালই
২০১৬ সালে খড়্গপুর শহরে দিলীপের হয়ে জনসভা করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সম্প্রতি মোদী মেদিনীপুরেও সভা করে গেলেন। মোদীর ওই সমাবেশ কোনও ঘোষিত নির্বাচনী সভা ছিল না, ছিল ‘কৃষক কল্যাণ সমাবেশ’। কিন্তু আসলে মোদী যে মেদিনীপুরের সভা থেকে নির্বাচনী দুন্দুভিটা বাজিয়ে গিয়েছেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরের সংশয় নেই। সভাস্থল হিসেবে মেদিনীপুরকে বেছে নেওয়ার নেপথ্যে বিশেষ ইঙ্গিত খুঁজছেন অনেকেই।
শুধু মেদিনীপুর বা শুধু দিলীপ ঘোষ নয়, গেরুয়া শিবিরে ভাসতে শুরু করেছে আরও বেশ কয়েকটি কেন্দ্র এবং বেশ কয়েক জন প্রার্থীর নাম। সে জল্পনা যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তা হলে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে চোখধাঁধানো লড়াই হতে পারে ২০১৯-এ। ২০০৯, ২০১৪— পর পর দু’টি লোকসভা নির্বাচনে বীরভূম থেকে তৃণমূলের টিকিটে জিতে এসেছেন শতাব্দী রায়। অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে এ বার বিজেপির প্রার্থী হতে পারেন আর এক অভিনেত্রীই। মহিলা মোর্চারোো রাজ্য সভানেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়কে শতাব্দী রায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী করা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ছাউনি নয়, মেদিনীপুরে খোলা মঞ্চেই পাল্টা সভা তৃণমূলের
লকেট সে বিষয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সাবধানী। তাঁর কথায়: ‘‘লোকসভা নির্বাচন এখনও অনেকটা দূরে। কে কোথায় প্রার্থী হচ্ছেন, তা নিয়ে এত তাড়াতাড়ি মন্তব্য করা যায় না।’’ কিন্তু বীরভূম কেন্দ্রে বিজেপি ‘গ্ল্যামারের বিরুদ্ধে গ্ল্যামার’ কৌশল নেওয়ার কথা ভাবছে বলে যা শোনা যাচ্ছে, তা কি একেবারেই ভিত্তিহীন? লকেট উড়িয়ে দিলেন না সম্ভাবনা। বললেন, ‘‘আমি বীরভূমে অনেক দিন ধরেই কাজ করছি। বিধানসভাতেও লড়েছি বীরভূম জেলা থেকেই। তার পরেও বীরভূমের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে আমার। সোমবারই সিউড়িতে খুব বড় মিছিল করলাম। এর পর দল যা বলবে তাই করব।’’
গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
দমদমে প্রার্থী হতে পারেন শমীক ভট্টাচার্য। ওই লোকসভা কেন্দ্রও পর পর দু’বার তৃণমূলের দখলে গিয়েছে। দু’বারই জিতেছেন সৌগত রায়। অধ্যাপক সৌগতর বিরুদ্ধে শমীকের মতো সুশীল মুখেই বিজেপি ভরসা রাখতে চাইছে বলে খবর। দমদম লোকসভা কেন্দ্রকে নিজেদের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়ও মনে করছে বিজেপি। প্রয়াত বিজেপি নেতা তপন শিকদারকে পর পর দু’বার জিতিয়েছিল দমদম। আর ২০১৪ সালে বসিরহাট দক্ষিণের মতো আসনে ধুন্ধুমার উপনির্বাচনে জিতে এসেছিলেন শমীক। দমদমের মতো আসন পুনরুদ্ধারের জন্য এ বার তাই শমীকে ভরসা রাখা হতে পারে বলে খবর।
রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র সায়ন্তন বসুও লোকসভায় টিকিট পাচ্ছেন বলে খবর। পুরুলিয়া কেন্দ্রে প্রার্থী করা হতে পারে সায়ন্তনকে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে পুরুলিয়ায় অপ্রত্যাশিত ভাল ফল হয়েছে বিজেপির। লোকসভায় এ রাজ্য থেকে যে ২২টি আসন বিজেপি টার্গেট করছে, তার মধ্যে পুরুলিয়ার নাম একেবারে প্রথম দিকে। একটু ভারী নামই খোঁজা হচ্ছে পুরুলিয়ার জন্য। সায়ন্তন যথেষ্ট পরিচিত মুখ। পুরুলিয়ার সাংগঠনিক পর্যবেক্ষকও তিনিই। সে সব কথা মাথায় রেখেই সায়ন্তন বসুর নাম সামনে আসছে।
তবে মন্তব্যের ব্যাপারে সায়ন্তনও একই রকম সাবধানী। তিনি বললেন, ‘‘লোকসভা নির্বাচনে কাকে কোথায় টিকিট দেওয়া হবে, সেটা দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব স্থির করেন। রাজ্য থেকে হয় না। দল যেখানে দাঁড়াতে বলবে, সেখানেই দাঁড়াব। যদি বলে দাঁড়াতে হবে না, তা হলে তাই হবে।’’
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় যে আবার আসানসোলেই দাঁড়াচ্ছেন, তা প্রায় নিশ্চিত। তবে আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া দার্জিলিং থেকে সম্ভবত লড়বেন না। ২০১৪ সালে বিমল গুরুঙ্গদের সমর্থন পেয়ে দার্জিলিং থেকে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন অহলুওয়ালিয়া। কিন্তু গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার রাশ এখন আর বিমল গুরুঙ্গের হাতে নেই। মোর্চার বর্তমান নেতৃত্ব যাঁদের হাতে, সেই বিনয় তামাঙ্গ-অনীত থাপাদের সঙ্গে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতাই বেশি। ফলে দার্জিলিং থেকে বিজেপি প্রার্থীর জয় এ বার খুব কঠিন। তাই অহলুওয়ালিয়াকে অন্য কোনও আসনে বা অন্য রাজ্যে প্রার্থী করা হতে পারে। প্রয়োজনে লোকসভায় টিকিট না দিয়ে পরে রাজ্যসভায় পাঠানো হতে পারে বলেও মনে করছেন বিজেপির একাংশ।
দার্জিলিঙে সে ক্ষেত্রে প্রার্থী করা হতে পারে চন্দ্রকুমার বসুকে। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পরিবারের সদস্য চন্দ্র বসুকে দার্জিলিঙে প্রার্থী করার ভাবনার নেপথ্যেও সুনির্দিষ্ট হিসেব রয়েছে। নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজে গোর্খা বাহিনীর ভূমিকা সুবিদিত। নেতাজিকে নিয়ে তাই গোর্খা মানসে আবেগও যথেষ্টই। চন্দ্র বসুকে দার্জিলিঙে প্রার্থী করে সেই আবেগে সওয়ার হওয়া যাবে, মনে করছে বিজেপির একাংশ।
প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা জাতীয় সম্পাদক রাহুল সিংহও ফের টিকিট পাচ্ছেন বলে খবর। তবে কলকাতার বাইরের কোনও আসনে রাহুল প্রার্থী হতে চান না বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাঁকে ফের উত্তর কলকাতাতেই টিকিট দেওয়া হতে পারে। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনেও রাহুল সিংহ ওই কেন্দ্রেই প্রার্থী হয়েছিলেন। তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে রাহুল হেরে যান। তবে সিপিএমের রূপা বাগচি বা কংগ্রেসের সোমনে মিত্রকে পিছনে ফেলে রাহুল দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। ২০১৯-এ পরিস্থিতি আরও ভাল বলে বিজেপির একাংশের দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy